User:M. A. Halim/Some my Article in Bangla/হায় বিদ্যুৎ! হায় মহানগরী!
হায় বিদ্যুৎ! হায় মহানগরী!
এই মুহূর্তে খুলনা মহানগরীর সবচেয়ে বড় সমস্যা কী?
এই প্রশ্ন করা হলে আমি নিশ্চিত বেশীরভাগ নাগরিকের উত্তর হবে- "বিদ্যুতের অসহনীয় লোডশেডিং।" অনেকে বলতে পারেন এটা সারা বাংলাদেশেরই এখন এক নম্বর সমস্যা। হ্যাঁ, এতেও দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। তবে যিনি একথা বলছেন তাঁকে উদ্দেশ্য করে বিনীতভাবে একটা কথা বলতে চাই- জনাব, আপনি যদি খুলনা মহানগরীর অধিবাসী হন তা'হলে কোন কথা নেই, যদি আপনি অন্য কোন মহানগরবাসী হন তাইলে দুইক্কান কতা আছে।
খুলনা মহানগরীর অধিবাসীর কাছে এখানকার বিদু্যৎ যন্ত্রণা সম্পর্কে কোন কথা বলার দরকার নেই। এ নগরের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত যে কোন বয়সী নাগরিক লোডশেডিং কাহাকে বলে? উহা কত প্রকার ও কি?কি? তা'র সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা বলে দিতে পারবেন দীর্ঘ সময় ধরে। যে নগরে একজন গ্রাহক এক ঘন্টায় নয়বার (দ্রষ্টব্য: ২৩ মে ২০০৬ সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত ১১ টা) বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের শিকার হন কিংবা প্রতি ১৫ মিনিট বিদ্যুৎ প্রাপ্তির পর আড়াই ঘন্টার লোডশেডিংয়ের মুখোমুখি হয়ে (দ্রষ্টব্য: ২২ মে ২০০৬ রাত ১১টা থেকে ভোর তিনটা) সারাটা রাত আকাশের তারা, মেঘ দেখে পুবাকাশ লাল রঙা হতে দেখেন তার চেয়ে এ প্রসঙ্গে ভাল আর কেই বা বলতে পারবেন?
লোডশেডিং সম্পর্কে ওপরের দু'টি উদাহরণের পরও কি আপনি দেশের অন্যান্য মহানগরের সাথে খুলনার তুলনা করবেন? সেটা করলে কি আপনি একই চিত্র দেখতে পাবেন বলে মনে করেন? আমার তা' মনে হয় না। বিদ্যুৎ বিভাগের দেওয়া তথ্য যা' দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রায়শঃই ছাপা হচ্ছে তা' পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে দেশে বর্তমানে পিক আওয়ারে (সন্ধ্যা সাড়ে ছ'টা থেকে রাত ১১টা) বিদ্যুৎ-এর গড় ঘাটতি ৭/৮শ' মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার তিন চতুর্থাংশেরও বেশী বিদ্যুৎ কিন্তু উৎপাদিত হচ্ছে। কোন কোন দিন বিদ্যুৎ-এর উৎপাদন পিক আওয়ারে ৩৮শ' মেগাওয়াট পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগই বলছে। তা' হলে খুলনায় লোডশেডিংয়ের এ অবস্থা কেন?
খুলনা সার্কেলে (খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা) পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ-এর চাহিদা গড়ে ১১০ মেগাওয়াট। অথচ লোডশেডিংয়ের পরিমাণ দেখে মনে হয় এ সার্কেলে সরবরাহ চাহিদার এক চতুর্থাংশও না। বিদ্যুৎ-এর লোড ডেসপাস সেকশানে টেলিফোন করে চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে তথ্য চাওয়া হলে টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে আঁতকে ওঠার শব্দ শোনা যায়। যেন মহাভারত অশুদ্ধ করার মতো কিছু একটা ঘটে গেছে। কোন তথ্য দেওয়া যাবে না, উপরের নির্দেশ। কোন তথ্য পেতে হলে ঢাকা অফিসের অনুমতি লাগবে। একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে আমার নগরীতে কতটা বিদ্যুৎ সরবরাহ হচ্ছে তা জানতে গেলে রাজধানী ঢাকা থেকে লিখিত অনুমতিপত্র নিয়ে আসতে হবে। এটা শোনার পর আপনার মনে হতেই পারে সেই বিখ্যাত উক্তিটা-"সেলুকাস! কী বিচিত্র এই দেশ।"
এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম মাত্র বছর কয়েক আগে আমাদের এক মন্ত্রী বিদ্যুৎ-এর লোডশেডিংয়ে অতীষ্ঠ হয়ে নাকি বিদ্যুৎ বিভাগের এক উর্ধতন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, দিনের বেলায় যে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় তা রাতের চাহিদা মেটানোর জন্য জমিয়ে রাখা যায় কি-না। সেই মন্ত্রীর অজ্ঞানতা নিয়ে আপনি হাসতেই পারেন কেউ মানা করবে না। তবে সমপ্রতি বিদ্যুৎ-এর লোডশেডিং নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলা হচ্ছে তা' বোধহয় কম হাস্যকর নয়। তেমনই দু-একটি যুক্তি আপনাদের সমীপে পেশ করছি-
- দেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা এত বেশী বেড়ে গেছে যে মোবাইলের ব্যাটারি চার্জ করার কারণেই দেশে লোডশেডিং হচ্ছে।
- দেশে শিল্প-কল-কারখানার সংখ্যা এত বেশী বেড়ে গেছে যে সেগুলো চালানোর ফলেই বিদ্যুৎ-এর এত সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এটা তো খুবই ভাল কথা যে দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু এ কথা সত্যি হলে তো ঢাকাইয়া ভানুর মতো আমাকে আবারও বলতে হয়, তাইলে দুইক্কান কতা আছে।
দেশে তা' হলে ব্যাপক হারে শিল্পায়ন হয়েছে। কিন্তু খুলনা কি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন? গত এক দেড় দশকে খুলনায় তো তেমন কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। বরং বন্ধ হয়ে গেছে খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল, খুলনা টেক্সটাইল মিল, বাংলাদেশ ম্যাচ ফ্যাক্টরী। পাটকলগুলো চলছে ধুঁকে ধুঁকে। কোন কোনটি বন্ধ হয়ে গেছে। আরও আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কোরাইশি স্টিল ফ্যাক্টরি, খেতাওয়াত অয়েল মিল। শিল্প নগরী খুলনায় এখন শিল্প কোথায়? শিল্পাঞ্চল খালিশপুরে যদি কেউ ১৫ বছর পরে এখন পা' রাখেন তার পক্ষে বোঝা কঠিন হবে যে তিনি ভুল করে অন্য কোথাও চলে এসেছেন কি-না। রাস্তা-ঘাট, শিল্প প্রতিষ্ঠানতো ঠিকই আছে তবে গোলমালটা কোথায়? মিলের ভেঁপুর শব্দ নেই, শ্রমিকের কোলাহল নেই। এ কোন খালিশপুর?
যাউকগ্যা, বলছিলাম বিদ্যুৎ নিয়ে আবারও ফিরে আসি বিদ্যুতে। গত ২৪ মে ২০০৬ তারিখে খুলনার বহুল প্রচারিত দৈনিক পূর্বাঞ্চলে একটা সংবাদ ছাপা হয়েছে। বিদ্যুৎ নিয়ে পত্রিকাগুলো এতই লিখছে যে এখন বিদ্যুৎ সংক্রান্ত সংবাদ পত্রিকার কাছেই কেমন যেন গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। মেজেন্টা রঙের রিভার্স হেডিংয়ে শেষ পাতায় চার কলামে প্রকাশিত এ সংবাদের শিরোনাম ছিল "লোডশেডিং, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ অতিষ্ঠ"। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, আগেরদিন অর্থাৎ ২৩ মে বিদ্যুৎ-এর খুলনা জোনের ২১ জেলায় ৫৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয় মাত্র ২৭৭ মেগাওয়াট। খুলনা জোনে চাহিদার অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।
খুলনায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের যেসব উৎপাদন কেন্দ্র রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড়টি অর্থাৎ ১১০ মেগাওয়াট উৎপাদন কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে পড়ে আছে। ৬০ মেগাওয়াটটি চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। টার্বোজেনারেটর এবং গ্যাস টার্বাইনগুলো চালানো হয় না অতিরিক্ত জ্বালানী খরচের কারণে। বার্জ মাউন্টেড দুটি সচল থাকলেও এর বিদ্যুৎ উৎপাদন শক্তি বেশ কমে গেছে। খুলনায় বিদ্যুৎ সরবরাহের সবচেয়ে বড় ভরসা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান খুলনা পাওয়ার কোম্পানী লিমিটেডের ১১০ মেগাওয়াট বার্জ মাউন্টেড।
এ অবস্থায় খুলনাবাসীকে বিদ্যুৎ সঙ্কট থেকে উদ্ধারের উপায় কি? এ প্রশ্ন নিয়ে আমরা গিয়েছিলাম বিদ্যুৎ বিভাগ, খুলনা জোনে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ন জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিশন কোম্পানীর কর্মকর্তা এবং নগরীর সচেতন মানুষের কাছে। সবাই একটা বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে খুলনায় বিদ্যুৎ-এর উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় নেই। তা' হলে সেটা তো দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। এছাড়া নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে অনেক টাকা দরকার। একটা গরীব দেশের পক্ষে হুট করে বিপুল পরিমাণ অর্থের যোগান দেওয়াটা খুবই কঠিন।
জানা গেল, খুলনায় পরিত্যক্ত অবস্থায় একটি বিদু্যৎ কেন্দ্র আছে। এ বিদু্যৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন কেন্দ্রের মালিকানাধিন নয়। ১৯৫৪ সালে স্থাপিত খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের নিজস্ব উৎপাদন মতা বৃদ্ধির সুবিধার্থে মিল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিছুদিন (৪/৫বছর) পরেই একটি কানাডিয়ান কোম্পানী খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরী করে দেয়। নিউজপ্রিন্ট মিলে ৩টি বিদ্যুৎ-এর প্ল্যান্ট আছে। প্রতিটি প্লান্টে ৮ মেগাওয়াট করে মোট ২৪ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন সম্ভব। ৩টি বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মধ্যে ১টি সফলভাবে চালু অবস্থায় মিল বন্ধ হয়ে যায়। বাকী ২টির মধ্যে ১টি রিপিয়ার করে চালুর অবস্থায় ছিলো এবং আরেকটি রিপিয়ারের প্রক্রিয়ায় ছিলো মিল বন্ধ করার পূর্বে। খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল বন্ধের পূর্বে ১৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার অবস্থায় ছিলো।
অর্থাৎ একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের বিদু্যৎ উৎপাদন প্ল্যান্ট তিনটি চালু করা হলে খুলনা মহানগরীসহ খুলনা সার্কেলে বিদু্যৎ ঘাটতি অনেকটা কমে যাবে এবং গ্রাহকদের দুর্ভোগ অনেকাংশে লাঘব হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সদিচ্ছাটাই জরুরী। আমরা খুলনার ভূক্তভোগী বিদ্যুৎ গ্রাহকরা আশা করবো যে সরকার অবিলম্বে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডকে হস্তান্তর করে দিয়ে খুলনাঞ্চলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে নাগরিকদের সীমাহীন দুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।