User:M. A. Halim/Some my Article in Bangla/সিপিপি: রূপান্তর মডেল ও 'সিডর'
সিপিপি: রূপান্তর মডেল ও সিডর
প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকির মাঝেও বৃহত্তর খুলনা জেলার ১০টি উপকূলীয় উপজেলায় আজ অবধি সরকারি পর্যায়ে চালু করা যায়নি Cyclone prepardness Programme (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী) বা সংেেপ সিপিপি। এই সিপিপি যে এ এলাকার জন্য কতটা জরুরী তা' সকলের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেল সুপার সাইকোন "সিডর"। বৃহত্তর খুলনার ১০টি উপকূলীয় উপজেলার মধ্যে শুধুমাত্র মোংলাতেই কার্যকর ছিল সিপিপি। দাতা সংস্থা অঙ্ফ্যাম-এর সহযোহিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তর সেখানে গড়ে তুলেছে সিপিপি'র আদলে স্বেচ্ছাসেবক দল। মোট ২৭টি দলের ৪০৫ জন প্রশিতি স্বেচ্ছাসেবীর অকান্ত শ্রম আর মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দ এখন ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন উপজেলার প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ। সুপার সাইকোন সিডর বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানার তিনদিন আগে থেকে শুরু করে ঝড়ের ২-৩ দিন পরে পর্যন্ত সিপিপি'র স্বেচ্ছাসেবকদের অকান্ত শ্রমের কারণে মোংলা উপজেলায় একজন মানুষকেও প্রাণ হারাতে হয়নি। উপজেলা জুড়ে সিডর ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালালেও তাতে সম্পদের হানী ছাড়া মানুষের প্রাণহানী ঘটেনি। উল্লেখ্য, সরকারিভাবে এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির তত্ত্বাবধানে ১৯৬৭ সাল থেকে এদেশের উপকূলীয় এলাকায় সিপিপি কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সিপিপি'র দ স্বেচ্ছাসেবকরা উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেই স্ব-স্ব এলাকার জানমাল রায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারা দুর্যোগ পূর্ববতর্ী, দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ পরবতর্ী কাজগুলো অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে পালন করে আসছেন। এর ফলে ১৯৭০ সাল পরবতর্ী সময়ে বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ে য়তির পরিমাণ উল্যেখযোগ্যহারে কমেছে। সারা বিশ্বে এই সিপিপি একটি মডেল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। এমনকি গত ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলে বাংলাদেশের এই দতা সেখানে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু গত ৪০ বছরেও অবহেলিত জনপদ খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতীরা জেলার উপকুলীয় এলাকায় এই কার্যক্রম চালু হয়নি। বৃহত্তর খুলনার ১০টি উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় গত ৪০ বছরেও 'ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচী' (সিপিপি) চালু করা হয়নি। উপজেলাসমূহ হচ্ছে ঃ বাগেরহাটের মোংলা, রামপাল ও মোড়েলগঞ্জ, খুলনার দাকোপ, কয়রা, বটিয়াঘাটা ও পাইকগাছা এবং সাতীরার শ্যামনগর, কালিগঞ্জ ও আশাশুনি। ফলে এসব এলাকার লোকজনকে প্রাণহানিসহ ব্যাপক য়তির কবলে পড়তে হয়। এসব এলাকায় ফানেল বা মোচাকৃতি ধরণের উপকূল রেখা, নিম্ন সমতল ভূমি, জনসংখ্যার বাড়তি ঘনত্ব এবং দুর্বলভাবে বাঁধ ও ঘর-বাড়ী তৈরি-প্রভৃতি কারণে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ে উপকুলীয় এলাকায় ব্যাপক য়তি হয়ে থাকে। এক হিসেবে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঝড়ের মধ্যে শতকরা ১৬টি বাংলাদেশে আঘাত হানে। বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ১.১২টি ঝড় আঘাত হানার সম্ভাবনা রয়েছে। উপকুলীয় এলাকায় আঘাত হানা তীব্র ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের য়তির সরকারি এক হিসাবে দেখা যায়, ১৯৭০ সালে ২২৩ কিলোমিটার গতিবেগের সুপার সাইকোনে ৫ লাখ লোক, ১৯৮৫ সালে ১৫৪ কিলোমিটার গতিবেগের হ্যারিকেনে ১১০৬৯ জন, ১৯৮৮ সালের ১৬২ কিলোমিটার গতিবেগের হ্যারিকেনে ২ হাজার জন এবং ১৯৯১ সালের ২২৫ কিলোমিটার গতিবেগের সুপার সাইকোনে ১ লাখ ৩৮ হাজার লোকের প্রাণহানি ঘটে। বেসরকারি হিসেবে এর সংখ্যা অনেক বেশী বলে ধারণা করা হয়। বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থা 'রূপান্তর' খুলনাঞ্চলে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের ল্যে গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কর্মকান্ড চালিয়ে আসছে। দাতা সংস্থা অঙ্ফ্যাম-জিবি'র সহায়তায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রূপান্তর ইতোমধ্যেই মংলা উপজেলায় ঘূর্নিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আদলে 'সমাজভিত্তিক দুযের্াগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে'র আওতায় ২৭টি কমিটি গঠন করেছে। প্রত্যেকটি কমিটিতে ১৫ জন করে মোট ৪শ' ৫ জন সদস্য রয়েছে। সকল সদস্যকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাথমিক চিকিৎসা ও উদ্ধার তৎপরতা এবং ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সংকেত বিষয়ক তিনটি প্রশিণ দেয়া হয়েছে। একই সাথে প্রত্যেকটি কমিটির জন্য ৩টি মেগাফোন, ৩টি রেডিও, ৩টি হেলমেট, ৩টি টর্চ লাইট এবং ১৫টি রেইন কোট ও ১৫টি গামবুট প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য এই সংগঠনের মংলা শাখা অফিসে গড়ে তোলা হয়েছে একটি আপদকালিন কেন্দ্র। যেখান থেকে প্রযোজন মতো সরঞ্জাম সরবরাহ করা সম্ভব হবে। বেসরকারি উদ্যোগে মংলায় সিপিপি'র কার্যক্রমের ফলে ঘূর্ণিঝড় 'সিডর' আঘাতে এই এলাকায় প্রাণহানি হয়নি। সিপিপি'র কমর্ীদের আগাম প্রস্তুতিসহ ঝড় পরবতর্ী উদ্ধার পদেেপর কারণে এই এলাকায় মানুষের তেমন তি হয়নি। মোংলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মেহেদী হাসান তার উপজেলায় রূপান্তর পরিচালিত সিপিপি প্রসঙ্গে বলেন, এবারের সিডর আঘাত হানার আগে থেকে শুরু করে দুযোগ পরবতর্ী উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে সিপিপি। ১৩ নভেম্বর ৪ নম্বর সতর্ক সংকেত ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই সিপিপি'র স্বেচ্ছাসেবকরা সাধারণ মানুষকে মাইযোগে সতর্ক করেছেন। ১০ নম্বর মহা বিপদ সংকেত ঘোষণা হওয়ার পর থেকে তারা বাড়ীতে বাড়ীতে গিয়ে সাধারণ ঝঁকিপূর্ণ মানুষদের এক প্রকার জোর করেই নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্র নিয়ে গেছেন। মূলত তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কারণেই মোয়লা উপজেলায় কোন প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, সিপিপি এলাকায় কাজ শুরুর সময় কোন কোন জনপ্রতিনিধি তাদের কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সিডর-এর পর থেকে তারাও উপজেলা প্রশাসনে সিপিপি;র ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। আমরা সিপিপি'র কর্মকান্ড নিয়ে কথা বলেছি মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তারিকুল ইসলাম তারেক-এর সাথে। তিনি বললেন, সিপিপি গঠনের শুরু থেকেই তিনি সব ধরণের সহযোগিতা প্রদান করে আসছেন। তার ইউনিয়নে সিপিপি'র স্বেচ্ছাসেবকরা অসাধারণ ভূমিকা পালন করায় এ ইউনিয়নে কোন প্রাণহানীর ঘটনা ঘটেনি। সোনাইলতলা ইউনিয়নে সিপিপি'র প্রগতি দলের সভাপতি সিরাজ হাওলাদার জানান, ১৩ নভেম্বর ঝড়ের পূর্বাভাসসহ ৪নং সতর্ক সংকেত পেয়ে তারা উপজেলায় প্রচার-প্রচারণার কাজ শুরু করেন। ঝড়ের আগে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চলে। এ সময়ের মধ্যে তারা লোকজনকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেন। আশ্রয় কেন্দ্র পরিপূর্ণ হওয়ার পর বাকীদের স্থানীয় মসজিদ, গীর্জা, উঁচু শিা প্রতিষ্ঠানে নেয়া হয়। এ সময় বৃদ্ধ, বিকলাঙ্গ, বয়স্ক ব্যক্তি ও অন্তঃস্বত্তা মহিলাদের যথাযথভাবে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়। ঝড়ের পর শেষ রাতে তারা উদ্ধার কাজে নামেন। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। স্থানীয় লোকদের সহায়তায় গাছপালা কেটে সড়ক পরিস্কার করে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজনকে নিরাপদে বাড়ি যাওয়ার পথ তৈরি করা হয়। তিনি বলেন, সিপিপি'র সদস্যরা সতর্ক সংকেত প্রচার, উদ্ধার কার্যক্রম করাসহ প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের েেত্র প্রশিণপ্রাপ্ত। তাদের রয়েছে উদ্ধার সরঞ্জাম। তাই, তাদের জোরদার কার্যক্রমের কারণে তাদের এলাকায় কোন প্রাণহানি হয়নি। তবে ঘরবাড়িসহ অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক তি হয়েছে। আমরা কথা বলেছি মিঠাখালী ইউনিয়নের উপদ্রুত উপকূল সিপিপি দলের সভাপতি নাজমুল হকের সাথে। তিনি এবং তার স্বেচ্ছাসেবক দল এলাকার মানুষের জান-মাল রায় ভূমিকা পালন করতে পারার আনন্দে তখনও মশগুল। সবার প্রশংসা পাচ্ছেন তিনি বলে জানালেন। তিনি এবং তার দল শুধু মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে-ই তার দায়িত্ব শেষ করেননি। ওই রাতে স্কুলে এবং মরহুম কবি রুদ্র মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র বাড়ীতে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫০০ মানুষের জন্য খিচুড়ির ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলেন এলাকার সামর্থ্যবানদের সহযোগিতায়। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ভোর রাত থেকেই তিনি তার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং এলাকার মানুষদের সাথে নিয়ে উদ্ধার কাজ করেছেন। সকালেই এলাকার রাস্তার উপর ভেঙে পড়া গাছ-পালা অপসারণ করা হয়েছে এবং যে সকল ঘর অল্প তিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো মেরামত করা হয়েছে সিপিপি'র স্বেচ্ছাসেবকদের উদ্যোগে। তিনি জানালেন ঝড়ের মাত্র দু'দিন আগে এমনকি ঝড়ের আগের দিন যখন সিপিপি কমর্ীরা যখন মেগাফোন দিয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করছিল তখন অনেকেই তাদের টিটিকিরি করেছে। কিন্তু ঝড় পরবতর্ীতে তারাই সিপিপিকে অভিনন্দিত করেছে তাদের প্রশংসনীয় কাজের জন্য। এটাকেই বড় স্বীকৃতি বলে স্বীকার করলেন নাজমুল। কথা হয় বুড়িরডাঙ্গা উপনিয়নের সিপিপি দলের সভাপতি মনীন্দ্র নাথ রায়ের সাথে সিডরের আঘাত হানার তিন দিন পরে। তিনি তখনও আবেগাপ্লুত। এলাকার মানুষদের প্রশংসার বানে ভাসছে তখনও সিপিপি'র স্বেচ্ছাসেবকরা। তার দলের কমর্ীরা শুধু মানুষজনকে সতর্ক করে, নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়েই দায়িত্ব শেষ করেননি। তারা উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছেন। এমনকি তাদের দলের কমর্ীরা ঝড়ে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা-ও দিয়েছেন। মনীন্দ্র জানালেন এলাকার অনেক বয়ঃজ্যেষ্ঠ্য মানুষ তাদের দলের স্বেচ্ছাসেবকদের জড়িয়ে ধরে আশীর্বাদ দিচ্ছেন। এটাকে তার জীবনের অনেক বড় পাওয়া বলেই মনে করেন মনীন্দ্র। সুপার সাইকোন সিডর আঘাত হানার রাতে নিজের ঘর ছেড়ে কোথাও যেতে চাননি সোনাইলতলা ইউনিয়নের আমড়াতলা গ্রামের সত্তুরোর্ধ সবিতা রাণী মন্ডল। কিন্তু সিপিপি'র ছেলে-মেয়েরা তাকে শেষ পর্যন্ত ঘরে থাকতে দেয়নি। তারা তাকে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে সাইকোন শেল্টার সেন্টারে। ঝড়ের পরে তিনি বুঝতে পেরেছেন সেদিন যদি সিপিপি'র কমর্ীরা এটা না করতো তাহলে তিনিসহ তার পরিবারের কয়েকজনের হয়তো প্রাণ হারাতে হতো। কারণ তার ঘরটা ভেঙে পড়েছিল কিছু সময়ের মধ্যেই। তিনি তার আর তার পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বাাঁচানোর জন্য প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করলেন সেই সব ছেলে-মেয়েদের যারা সেই ঝড়ের রাতে তাকে জোর করে তুলে এনেছিল আশ্রয় কেন্দ্রে।