User:M. A. Halim/Article: মৃত্যুর পর মৃত্যু পেরিয়ে যে দেশের জন্ন

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

মৃত্যুর পর মৃত্যু পেরিয়ে যে দেশের জন্ম

মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী
খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে ডুমুরিয়া থানা, তারপর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। এ থানার ভেতরে চুকনগর বাজার একটি সুপরিচিত গঞ্জ। তিনদিকে নদীঘেরা বাজারটি ভদ্রা নদীর পারে অনেক কাল হলো গড়ে উঠেছে। নৌকাযোগে সেখানে যাওয়া যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন সহজ ছিল। তারপর সেখান থেকে সাতক্ষীরা সড়ক ধরে পশ্চিমবঙ্গে হেঁটে আশ্রয় নেওয়া। হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহায়ক দেশি দালালদের নৃশংস ও অসভ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনগণের এটাই ছিল প্রথম প্রতিবাদ−দেশত্যাগ।
১৯৭১ সালের ১৯ মে বিকেলবেলা সরলা মন্ডল তাঁর স্বামী, এক পুত্র ও তিন কন্যাসহ নিজ গ্রাম থেকে সকালবেলা যাত্রা করে নৌকাযোগে চুকনগর বাজারে পৌঁছালেন। সঙ্গে চার ভাইপো। পরদিন সকালে তিন পুত্রসহ কমলা রায় নৌকায় করে চুকনগরে এলেন। তাঁর গ্রামে রাজাকারদের অত্যাচার ও লুটতরাজে অতিষ্ঠ হয়ে তাড়াহুড়ায় অভুক্ত অবস্থায় তাঁরা যাত্রা শুরু করেছিলেন। চুকনগর পৌঁছে মায়ে-ছেলেয় নাশতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অল্প কিছুক্ষণ পর সেখানে পৌঁছাল কয়েকটি নৌকায় করে শিবনগর গ্রাম থেকে ৫০ জনের অধিক বৃদ্ধ-প্রৌঢ়-যুবক-শিশু নরনারীর দল। ইতিমধ্যে হেঁটে হাজার হাজার লোক চুকনগরের বাজার ছাড়িয়ে আশপাশে চুকনগরের স্কুল মাঠে, গোহাটায়, কালীমন্দির ও বটতলায়, ভদ্রা নদীর পারের বলের মাঠে, পাতখোলার বিলের ধারে, রায়পাড়ার গাছগুলোর তলে ও ঝোপঝাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ ভাত রান্না করছে, কেউ ভাতা রান্না হওয়ায় খাওয়া শুরু করেছে। সবারই তাড়াহুড়া। তখন জ্যেষ্ঠ মাস−রোদের তেজ কমলেই যাত্রা করবে স্বদেশ ছেড়ে আশ্রয়ের খোঁজে।
সহসা তিন দিক থেকে অসহায় মানুষগুলোকে ঘিরে ফেলল অস্ত্র হাতে হানাদার বাহিনী। পথ দেখিয়ে এনেছে স্থানীয় একদল রাজাকার। চুকনগরের শ্যামল কান্তি বিশ্বাস তাঁর ছোট বোনকে নিয়ে পুকুরে তখন স্মান করছিলেন। এমন সময় শুরু হলো ব্রাশফায়ার। তিনি বোনকে নিয়ে অন্য গ্রামে আশ্রয় নেন। বাড়িতে ফিরে মায়ের কাছে শোনেন তাঁর বাবাকে মেরে ফেলেছে। কমলা রায় জবানবন্দি দিচ্ছেন: ‘আমাদের আর নাশতা খাওয়া হলো না। নৌকা থেকে আমার এক ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। দেখলাম, রাইফেলের মাথায় যে ছোরা থাকে, সেটা দিয়ে তাকে মারছে। আমি পাগল হয়ে পানিতে ঝাঁপ দিলাম। কাপড় কোথায় ভেসে গেল। সায়া-ব্লাউজ পরা অবস্থায় দেড় ভড়ি সোনার গয়না ও টাকা-পয়সা যা ছিল সব ওদের সামনে ফেলে বললাম, আমার ছেলেটাকে আর মারবে না। তারা ছেলেটিকে ধাਆা দিয়ে সরিয়ে দিল। বুকে জড়িয়ে ধরে তাকে নদীর ধারে নিয়ে গেলাম জলপানের জন্য। জল খাওয়াব কী! দেখি, মারা গেছে। আর দুটো ছেলে কোথায় গেল বলতে পারব না।’ সরলা মন্ডল জবানবন্দি দিচ্ছেন: ‘দুজন হানাদার সেনা গুলি করল। আমার স্বামী গেল, আমার ছেলেটা গেল, আমার ভাইপোগুলান গেল।’ দুপুরবেলা গুলির শব্দ শুনলেন সন্তোষ দাস। দুর থেকে দেখতে পেলেন হানাদার বাহিনীর একটি দল পাতখোলার বিলে ব্রাশফায়ার করে পাখির মতো মানুষ মারছে। তাদের আরেকটি দল তাদের গ্রাম পুঁটিমারীর দিকে ব্রাশফায়ার করতে করতে এগোচ্ছে−পথিমধ্যে থেমে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। পরক্ষণে দেখলেন অনেকের সঙ্গে তিনিও দিশেহারা হয়ে ছুটছেন।
নদীর পারে বটগাছ। বটগাছের ছায়ায় কালীমন্দির। আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে বটগাছের ডালে, কেউ কেউ আশ্রয় নিয়েছে কালীমন্দিরে, সেখানে জায়গা না পেয়ে আশপাশের চত্বরে। নিস্তার পেল না একজনও। পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে বটগাছ থেকে মাটিতে পড়তে লাগল। গুলি ফুরিয়ে গেলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হলো যারা ছিল মন্দিরে, আশপাশের চত্বরে। বসুন্তিয়া গ্রামের সুভাষ রায় তখন এসএসসি পরীক্ষার্থী। যশোর-সাতক্ষীরা সড়কের পাশে তাঁদের জমিতে চাষ করছিলেন। গুলির শব্দ শুনে লাঙল ফেলে নিরাপদ আশ্রয় নেন। তাঁর জবানবন্দি: ‘নরনিয়া ছেড়ে চুকনগরের বাজারে ঢুকি। দেখি, লাশ আর লাশ, রক্তের স্রোত রাস্তার ময়লা-মাটি ধুয়ে নদীতে পড়ছে। নদীর চরে কাদায় পড়ে আছে হাজারও লাশ। বটগাছের নিচে, শিকড়ের ভেতরে, কালীমন্দিরের ভেতরে শুধু লাশ, আহতরা ছটফট করছে। গোহাটার পাশে একটি পুকুরের ভেতরে লাশ ছটফট করছে, হাতের হুঁকা হাতে আছে−লাশ হয়ে পড়ে আছে। মহিলাদের লাশ তাদের কোলের শিশুদের লাশ জড়িয়ে পড়ে আছে। এ ভয়াল দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই।’
ওয়াজেদ আলীর জবানবন্দি: ‘বাঁশের ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে পাটের দড়ি দিয়ে বাঁক তৈরি করে আমরা ৩০ জন লোক লাশ ফেলার কাজ করি। আমরা নদীর চরের লাশের হাত-পা বেঁধে ঘাড়ে করে বয়ে ভদ্রা নদীতে ফেলি। অন্য স্থানের লাশগুলো টেনে-হিঁচড়ে ফেলি ডোবা আর নিচু জায়গায়। সব মিলে আমরা হাজার দশেক লাশ ফেলেছি।’ লাশ বহনকারী আরেক দলের সদস্য শের আলী বলেন, ‘আমার দলের লোকেরা চার হাজার লাশ গোনার পর আর হিসাব রাখেনি।’
শ্যামাপদ দেবনাথের জবানবন্দি: ‘এর পরও হাজার হাজার লাশ নদীর স্রোতের টানে এদিক-সেদিক ঘুরেছে পাঁচ-ছয় মাস ধরে। ভদ্রা নদীর উজানে ত্রিমোহনায় অন্য শাখা নদীর প্রবাহ। একটি হরিহর, অপরটি বুড়িভদ্রা। হরিহর নদী আবার দুটি শাখা নদী হয়ে বয়ে গেছে। তৎকালে ভদ্রা নদীতে ছিল খরস্রোত, দুই ধারে চর। চরে ছিল কেয়াবন, হোগলাবন আর কেওড়ার ঝাড়। চুকনগরের ভাসমান লাশগুলো উজানে ১৪-১৫ কিলোমিটার দুরে চলে যেত। আবার ভাটিতে চুকনগরে ফিরে আসত। তবে সবগুলো নয়−ভাটিতে হরিহর, বুড়িভদ্রা ও ভদ্রা নদী তিনটির চরে বনবাদাড়ে লাশ আটকে যেত। সেগুলো কুকুর, শিয়াল, শকুনের দল ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেত। এতে অনায়াসে অনুমান করা যায় মৃতের সংখ্যা ৩০ হাজারের কম হবে না।
ঘটনার দিন সকালবেলা খুলনা-সাতক্ষীরা সড়ক ধরে হানাদার বাহিনীর একটি দল অস্ত্রহাতে যখন এগোচ্ছিল, তখন পাশে নিজ জমিতে চিকন মোড়ল সদ্য জেগে ওঠা ধানের ক্ষেতে ঝুঁকে নিড়ানোতে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের দেখে কাঁচিহাতে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই চিকন মোড়লের বুকে গুলি এসে লাগে। তিনি মারা যান। সেদিন বিকেলে তাঁর ছেলে বাবার খোঁজে বের হন। সর্বত্র লাশ এলোপাতাড়ি পড়ে আছে। হঠাৎ এরশাদ আলী কান্নার আওয়াজ শুনতে পান। দেখেন, মৃত মায়ের বুকে ক্রন্দনরত এক শিশুকন্যা, বয়স পাঁচ-ছয় মাস হবে। মৃত মায়ের সিঁথিতে সিন্দুর দেখে তিনি শিশুটিকে কোলে নিয়ে নিঃসন্তান মান্দার দাসের বাড়ি যান। নিঃসন্তান দম্পতি শিশুটিকে লালন-পালনের ভার নেয়। দেখতে ফুটফুটে। তাই তার নাম রাখা হয় সুন্দরী। সম্ভবত সেদিনের নিধনযজ্ঞে সে একমাত্র জীবিত মানুষ।
বিলম্বে হলেও চুকনগরের বধ্যভুমিগুলোর একটিতে ৩০ মে, ২০০৯ ‘চুকনগর হত্যা দিবস’ পালন করা হয়েছে। আমার বাঁ পাশে দাঁড়িয়ে সুন্দরী− অসুস্থ স্বামী বাটুল দাস আর নাবালক দুটি পুত্র নিয়ে তাঁর দুঃখের সংসার। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সুন্দরীকে নগদ ১০ হাজার টাকা দেওয়া হলো। এতে তাঁর দুঃখ ঘোচার নয়, তবে কিছুটা কমবে। মঞ্চে বসে বক্তাদের বক্তৃতা শুনতে শুনতে চারদিকে তাকালাম। ধানের চারা বহুদুর পর্যন্ত বাতাসে স্পর্শে হেলছে-দুলছে। বধ্যভুমির কোনো চিহ্ন আর নেই। অথচ একদিন চারদিকে গাদাগাদি করে পড়ে ছিল হাজার হাজার লাশ। গুলিতে, বেয়নেটের কোপে ক্ষতবিক্ষত লাশ−মেয়ের পিঠের ওপর মায়ের পা, বোনকে জড়িয়ে ধরে ভাই, উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বৃদ্ধা, মাথার সাদা চুলে রক্তে মাখামাখি, হাতে ধরা একটি আলু−আলুভর্তা দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। অদুরে গাছের ডালে কয়েকটি কাক ডেকে উঠল। দুরে একঝাঁক শালিক মাঠে ঘুরছে। তবে কি শহীদেরা ফিরে এসেছে কাক আর শালিকের বেশে?
পাদটীকা: চুকনগরের মধ্যে যেটি বৃহৎ বধ্যভুমি, অবিলম্বে সেখানে ‘নিধনযজ্ঞ জাদুঘর’ নির্মাণ করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার অবিলম্বে শুরু করতে হবে। ১৯৭২ সালের সংবিধান কোনো পরিবর্তন ছাড়া প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই তিনটি কাজ দ্বারাই কেবল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শহীদদের রক্তের ঋণের দেনা শোধ হবে। (সহায়ক গ্রন্থ: মুনতাসীর মামুন, চুকনগরের গণহত্যা, ইব্রাহিম রেজা, গণহত্যা চুকনগর।)
মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী: অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আপিল বিভাগ, সুপ্রিম কোর্ট।