সমন্বিত মৎস্য চাষ
নোয়াখালীর উপকূলীয় খাস জমির জটিলতা-৫
নোয়াখালীর উপকূলীয় খাস জমির জটিলতা-৫
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
সমন্বিত মৎস্য চাষ: উপকূল যেন সোনার খনি
নোয়াখালীর সুধারাম থানার দক্ষিণে থানার হাটে প্রায় পাঁচ একর জমিতে তিন বন্ধু মিলে গড়ে তুলেছে একটি মৎস্য খামার। কামাল, শাকিল আর আনিছ ছিলো বেকার যুবক ; স্বপ্ন ছিল তিনজনে মিলে একটা কৃষি-প্রকল্প গড়ে তুলবে। কিন্তু তারা ঠিক সুবিধা করতে পারছিলো না। শেষে নোয়াখালী মৎস্য দপ্তরের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করলে মৎস্য বিভাগ তাদেরকে একটি মৎস্য প্রকল্প গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ এবং ধন দেয়। সোনাপুরের হ্যাচারী থেকে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করে তিন বন্ধু তাদের প্রকল্পে অন্যান্য মাছের সাথে গলদা চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয়। প্রথম অবস্থায় তারা এক হাজার চিংড়ি পোনা ছেড়ে ৫ মাস পরে পেয়েছে ৮৮৮টি চিংড়ি। নিজের প্রত্য অভিজ্ঞতা থেকে প্রকল্পের অন্যতম উদ্যোক্তা কামাল উদ্দিন জানান, সমন্বিত পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করলে স্বাভাবিকের তুলনায় বহুগুণ বেশি লাভ পাওয়া যায়।
গ্রেটার নোয়াখালী একোয়াকালচার এক্সটেনশন প্রজেক্ট (জিএনএইপি) অর্থাৎ বৃহত্তর নোয়াখালী মৎস্য সম্প্রসারণ প্রকল্প মূলত নিুবিত্তের ছোট ছোট পরিবারগুলোকে সরাসরি সহযোগিতা করে আসছে। কিন্তু তারা কোনো প্রকার আর্থিক সহযোগিতা দেয় না ; কারিগরি জ্ঞানসহ মৎস্য সংরণ ও বাজারজাতকরণের যাবতীয় সহযোগিতাই করছে। এ বিষয়ে জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। মৎস্যচাষ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য গ্রামের কৃষকরা এখান থেকে পেয়ে থাকে। বৃহত্তর নোয়াখালীতে এরকম ৫০টি তথ্যকেন্দ্র রয়েছে। তথ্যকেন্দ্রটি পরিচালিত হয় একটি কমিটির মাধ্যমে। কমিটির সদস্যরা এলাকারই কৃষক। শুধু মৎস্যই নয় এই তথ্যকেন্দ্র থেকে তারা কৃষি সংক্রান্ত বিষয়ে অবগত হতে পারেন।
পুকুরে অন্য মাছর সাথে গলদা চিংড়ি চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন দেখে এখন এলাকায় অনেকেই উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। নবগ্রামের হনুফা বেগমের স্বামী সৈয়দ আহম্মদ প্রায় ৫ বছর আগে টিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ৪ ছেলে, ১ মেয়ে নিয়ে হনুফা খুব অসহায় হয়ে পড়েন। পনের বছর আগে সরকার থেকে তারা দেড় একর কৃষি-জমি বন্দোবস্ত পায়। সেই জমিতে বিশ ডেসিমেল আয়তনের একটি পুকুর কেটে ঘরের ভিটা ও কিছু জায়গা উঁচু করেছে। উঁচু জায়গায় নারকেল, আম, সুপারিসহ নানান গাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু স্বামী মারা যাবার পর হনুফা খাতুন ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। স্বামীর চিকিৎসা ও সংসারের খরচ মিটানোর জন্য ভিটে ছাড়া বাকি সব জমি স্থানীয় এক অবস্থাপন্ন কৃষকের কাছে বন্ধক দেন। বন্ধকের পরিমাণ নয় হাজার টাকা। হনুফা বেগম ৪/৫ বছর বহু চেষ্টা করেও জমিটি বন্ধক থেকে ছাড়াতে পারেননি। পুরো জমিটি যখন হাতছাড়া হয়ে যাবার উপক্রম হলো তখন তিনি যোগাযোগ করেন তথ্যকেন্দ্রে। সেখান থেকে পরামর্শ অনুযায়ী তিনি তার ছোট পুকুরে পরিকল্পিতভাবে ৩ হাজারটি গলদা চিংড়ির পোনা ছাড়েন। ৫ মাস প্রয়োজনীয় পরিচর্যার পর তিনি তা বিক্রির জন্য ধরেন। ধরার সময় গুণে দেখেন ২৪৮২টি মাছ টিকে গেছে। প্রতিটি চিংড়ি তিনি বিক্রি করেন পাঁচ টাকায়। খরচপাতি বাদে তার লাভ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা ; নয় হাজার টাকা দিয়ে তিনি তার বন্ধকী জমি ছাড়িয়ে নেন। বাকি টাকায় একটি বাছুর ও কিছু হাঁস ও মুরগি কেনেন। এ বছর তিনি আবার তৈরি হচ্ছেন গলদা চিংড়ি চাষ করার জন্য। হনুফা আশা করছেন এ রকম চাষ করলে তার ভাগ্য অচিরেই ফিরে যাবে। লক্ষ্মীপুরের সমিতির হাট থেকে নদীভাঙ্গনের ফলে হনুফারা এ অঞ্চলে একটুকরা জমির আশায় ছুটে আসেন। তার পৈতৃক জমি গ্রাস করে ফেলেছে মেঘনা। সেখানে আর যাওয়ার উপায় নেই। বড় ছেলে জাফর চট্টগ্রামে রিক্সা চালায়। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সেখানেই থাকে। মাে য়র মাছ বিক্রির খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলো টাকার ভাগের জন্য। সুবিধা করতে না পেরে আবার ফিরে গেছে। হনুফা’র একমাত্র মেয়ে তসনিমা ৪র্থ শ্রেণীতে পড়ে। হনুফার আশা মেয়েকে অনেক দূর পড়াবেন। ভালো ঘর দেখে বিয়ে দেবেন।
এভাবে নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে পাইলট প্রোগ্রামের অধীনে প্রায় ৫০০টি পারিবারকে জিএনএইপির আওতায় কারিগরি সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। সরকারি খাসজমি বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ায় এই পরিবারগুলো জমির মালিক হয়েছে। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে ৪০ ডিং পুকুর। এই চাষে প্রথমে তেমন কেউ উৎসাহী হয়নি। কারণ কৃষকরা মনে করতো, গলদা বা বাগদা চিংড়ি চাষের মতো পরিবেশ এখানে হবে না। কিন্তু গলদা চিংড়ি মিঠা পানির মাছ হওয়াতে সে সমস্যা একেবারে নেই। স্বাভাবিক মৎস্য চাষের সঙ্গে সমন্বিতভাবে গলদা চিংড়ি চাষ করা অনেক লাভজনক। নোয়াখালীর চরাঞ্চলের অনেক দরিদ্র কৃষক বর্তমানে সমন্বিত চিংড়ি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।
ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের জন্য’ ৮০ সালে নোয়াখালী সদরের চর বামনায় ভূমিহীনদের জন্য একটি গুচ্ছগ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়। সেসময় গুচ্ছ গ্রামটির নামকরণ করা হয় চন্দ্রমুখী। এ গুচ্ছগ্রামটিতে ১৩টি পরিবার এক একর পঞ্চাশ ডেসিমেল করে জমি বরাদ্দ পায়। একটি বড় পুকুর কেটে তার চতুর্দিকে পরিবারগুলোকে ভিটা বরাদ্দ দেয়া হয়। পুকুরের মধ্যেও পরিবারগুলোর মালিকানা নিশ্চিত হয়। পুকুর, ভিটা ও ধানী জমি মিলে প্রতিটি পরিবার মোট দুই একর করে জমির মালিক হয়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো যে এ পরিবারগুলোর নারীরা সবাই ছিলো বিধবা। সে কারণে এ কলোনীকে বিধবা কলোনী বলা হয়। নেদারল্যান্ডের আর্থিক সহযোগিতায় এ গুচ্ছ গ্রাম প্রতিষ্ঠিত হয়।
চন্দ্রমুখী গুচ্ছগ্রামের মনোয়ারা বেগম ও হনুফা বেগম-দুজনই বিধবা ছিলেন। এখন তারা আবার বিয়ে করেছেন। তারা জানান চন্দ্রমুখী গুচ্ছগ্রামের ১৩ জন অধিবাসী নিয়ে তারা একটি দল গঠন করেছেন। এ দলে সবাই মহিলা। গুচ্ছ গ্রামের দেড় একর আয়তনের পুকুরে তারা সমবায় ভিত্তিতে মৎস্যচাষ শুরু করেন ২০০২ সাল থেকে। নোয়াখালী মৎস্য সম্প্রসারণ বিভাগ তাদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিণ দেয়। এল্েয এ পুকুরে কাতল, সিলভার কার্প, রুই, মৃগেল, সরপুটি, গ্রাসকাপ প্রভৃতি জাতের মাছের সাথে গলদা চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে। এ চাষের জন্য পোনা খরচ বাবদ ৮ হাজার ৮৪ টাকা মৎস্য বিভাগ ঋণ হিসাবে প্রদান করে। এক বছর পর তাদের লাভ হয় ত্রিশ হাজার টাকা। এভাবে গুচ্ছ গ্রামের প্রতিটি ভূমিহীন পরিবার মৎস্য চাষ করে আয়ের উৎস খুঁজে পেয়েছে।
জেলা মৎস্য সম্প্রসারণ বিভাগ ও জিএনএইপি জানায়, উপকূলীয় জেলার সুধারাম থানায় ৬০টি গুচ্ছগ্রাম রয়েছে। প্রতিটি গুচ্ছগ্রামে গড়ে ন্যূনপে একটি বড় পুকুর বা দীঘি রয়েছে। এসব দীঘিতে সমন্বিত মৎস্য ও চিংড়ি চাষ করলে দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখা সম্ভব হবে। বর্তমানে ৩০টি গুচ্ছগ্রামে এ প্রকল্প সন্তোষজনকভাবে শুরু হয়েছে। এখানে রয়েছে ১ হাজার ৮’শ পরিবার।
মৎস্য চাষের এই প্রকল্প শুধুমাত্র নোয়াখালীর চরাঞ্চল কিংবা উপকূলেই নয়, বৃহত্তর নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ জলাবদ্ধ এলাকায়ও নেয়া হচ্ছে। বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, চাটখিল ও লক্ষ্মীপুর জেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় বছরে ছয়-সাত মাস জলাবদ্ধতায় কোনো ফসল উৎপন্ন হয় না। অথচ এই সব জলাভূমিকে সামান্য সংস্কার করে সমন্বিত মৎস্য চাষ করলে কৃষকরা অধিক লাভবান হবেন বলে মৎস্য সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে। পরীামূলকভাবে বেগমগঞ্জের একলাসপুর ইউনিয়নের ওলি আহম্মদ মানিক তার ৫ একর জলাবদ্ধ জমিতে সমন্বিত চিংড়ি চাষ করে বিপুল পরিমাণে লাভবান হয়েছেন। তিনি জানান, ৫ একর জমিতে তিনি প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ করে রুই, কাতলা জাতীয় মাছের সাথে চিংড়ি চাষ করেন বছর শুরু হওয়ার সাথে সাথেই। মাত্র ৭ মাসে তিনি সে জমি থেকে দেড় ল টাকা আয় করেন শুধুমাত্র গলদা চিংড়ি থেকে। এলাকার অন্যান্য চাষীরা বলেন, দীর্ঘ দিন এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা তাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে মৎস্য অধিদপ্তরের গৃহীত প্রকল্পে এখন সে অভিশাপ আর্শিবাদে রূপ নিয়েছে।
লক্ষ্মীপুরের চন্দ্রগ্রাম বাজারের পাঁচপাড়া গ্রামের খালেকগঞ্জ বাজারে রয়েছে মুনস্টার যুব উন্নয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি। এই সমিতি ২০০০ সনে জলাবদ্ধ জমিতে এবং পাশ দিয়ে বয়ে চলা বদ্ধখালে পরীামূলকভাবে মৎস্য চাষ শুরু করে। সমিতির সম্পাদক জহিরুল ইসলাম লিটন জানান, কীটনাশক ব্যবহারের ফলে তাদের এলাকায় দিন দিন ঐতিহ্যবাহী ছোট মাছগুলো কমে আসছিলো। বর্তমানে তারা সমিতির উদ্যোগে জলাবদ্ধ জমি ও খালের ৩০০ মিটার ইজারা নিয়ে মৎস্যচাষ শুরু করেন। নানা জাতের মাছের সাথে তারা গলদা চিংড়ি চাষ করেন। তিনি জানান, গত বছর প্রাকৃতিকভাবে তারা পুটি, বাইম, পাবদা এবং এরকম ২৩ প্রজাতির মাছ পেয়েছেন ১২০ কেজি। যা আগের তুলনায় অনেক কম। পরবর্তী বছর তারা আবার মাছ চাষ করেন। কৃষকদের তারা উৎসাহী করে তোলেন কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করার জন্য। এ বছর তারা নুতন প্রজাতির আরো ৩টি মাছ পেয়েছেন। গলদা চিংড়ি ছাড়া হয়েছিলো ৫০০টি ; পেয়েছেন ৩৯৭টি। তারা জানান, এ প্রকল্প থেকে ১ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। সমিতিতে রয়েছে ১৫ জন সদস্য ; তারা সবাই একমত হয়ে জানান, জলাবদ্ধ জমিতে সমন্বিত মৎস্য চাষ করলে লাভবান হওয়া যায়। জিএনএইপি’র লক্ষ্মীপুরের সমন্বয়ক তারিক আকবর জানান, ধান আমাদের প্রধান ফসল। এই ফসল বাদ দিয়ে আমরা কৃষককে মৎস্যচাষ করার উৎসাহ দেই না। ধান চাষ করেই কৃষকরা মৎস্য চাষ করতে পারছে। শুধু জলাবদ্ধ জমিতে এই এই ব্যবহার করা যেতে পারে। লক্ষ্মীপুর জেলার ভাংখা খাঁ ইউনিয়নের বাংখা গ্রামের ১৫ জন মহিলা নিয়ে একটি সমবায় সমিতি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেকেরই আছে দশ থেকে ত্রিশ শতাংশের পুকুর। এই পুকুরগুলোতে তেমন মাছ চাষ করা হতো না। বাড়ির সীমানার মধ্যেই এই পুকুরগুলো অবস্থিত। বাড়ির মানুষেরা গৃহস্থালীর কাজে পুকুরগুলো ব্যবহার করে। এগুলো এতদিন উৎপাদনহীন অবস্থায় ছিল। সমতির সদস্যরা পুকুরগুলো সংস্কার করে সমন্বিত মাছ চাষ করছে। উল্লেখ্য যে, সব পুকুরেই গলদা চিংড়ি চাষ হচ্ছে। মাছের খাদ্যের জন্য কোনো কৃত্রিম খাবার দেয়া হয় না। পুকুরে হাঁড়ি পাতিল ধোয়ার সময় ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া সেল, কুঁড়া, চিটাগুড়, শুটকী গুড়ো ইত্যাদি দিয়ে খুব অল্প খরচে সহজে মাছের খাদ্য উৎপাদন করার একটি সহজ পদ্ধতি গ্রামীণ নারীরা উদ্ভাবন করেছেন। মৎস্য সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, খুব সহজ পদ্ধতি ও কম খরচে কি করে মৎস্য চাষ করা যায় সে বিষয়ে তারা কৃষকদের সার্বণিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। গ্রামীণ নারীদের অনেকেই বলেছেন, ঘরের মধ্যে থেকেও মৎস্য চাষ করে তারা লাভবান হচ্ছেন। তবে সমিতি ছাড়াও ৩০০ থেকে ৩৫০ জন মহিলা ব্যক্তিগত উদ্যোগে মৎস্য চাষ করেছেন। গৃহিনী খুকী বেগম ও রেহানা বেগম জানান, ২০০১ সাল থেকে তারা সমন্বিত মৎস্য চাষ করছেন। নতুনভাবে তারা এই চাষ শুরু করেছেন। তবে তারা জানান, খুব আশাপ্রদ না হলেও নিরাশ হওয়ার মতো কিছু এখনো ঘটেনি।
বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা মৎস্য অধিদপ্তর (জিএনএইপি) ও এনজিও সমন্বয়ে মৎস্য চাষসহ গলদা চিংড়ির ব্যাপক প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এর সুফল ল্য করা যাচ্ছে। এ বিষয়ে লক্ষ্মীপুরের ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা এ কে এম সিদ্দিক জানান, লক্ষ্মীপুরে ত্রিমুখী কার্যক্রম তিনটি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। মৎস্য অধিদপ্তর, এনজিও কোডেক এবং মূল সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে জিএনএইপি থেকে। মূল প্রজেক্টে রয়েছেন ৩ জন কর্মকর্তা এবং প্রতিটি উপজেলায় রয়েছেন ১ জন করে কর্মকর্তা। মাঠ পর্যায়ে রয়েছেন মৎস্য কর্মকর্তারা। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা, সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা এবং মাঠ সহায়কগণ এ প্রকল্পের সার্বিক সহযোগিতা করছেন। তারা প্রতিটি ইউনিয়নে ট্রেনিং, গ্র“পিং, কারিগরি সহযোগিতা ইত্যাদি সার্বিক দেখাশুনা করছেন। প্রতিমাসেই জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মিটিং হচ্ছে। উপজেলায় যে কমিটি আছে তার সভাপতি উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা এবং জেলার সভাপতি জেলা মৎস্য কর্মকর্তা। কোনো সমস্যার সমাধান না করতে পারলে তা জেলার প্রজেক্ট মনিটরিং কমিটির (পিএসসি)-র কাছে পাঠানো হয়। সার্বিক কর্মকাণ্ড নোয়াখালীর মাইজদীতে মূল অফিসে ম্যানেজম্যান্ট কমিটি’র সমন্বয় করা হয়। প্রতিমাসেই এর সভা হয়।
এ কে এম সিদ্দিক জানান, আমি ২০০১ সালে এখানকার অফিসে যোগ দেই। প্রথমেই আমি কিছু সমস্যায় পড়েছিলাম। আমরা মূলত কৃষকদেরকে মাছ চাষে উদ্বুব্ধ করছি। প্রজেক্টের মাধ্যমে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকার টেকনিক্যাল সহযোগিতা করা হয়। মূলত দরিদ্র শ্রেণীর কৃষকদের নিয়ে কাজ করছি। আমাদের মূল কাজ মাছ চাষ করা ; মাছ চাষের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন করা। এই মাছ চাষ কি করে বিজ্ঞান সম্মতভাবে করা যায় তা দশটি মডিউলের মাধ্যমে ট্রেনিং দেয়া হয়। এদের জন্য একটি সঞ্চয় প্রকল্প রয়েছে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। প্রতিমাসে গ্র“পগুলোর দু’টি করে সভা হয়। সঞ্চয় থেকে তারা অর্থ নিয়ে প্রয়োজনে কাজে লাগাতে পারে। সমস্যা যেটা তা হলো, এর আগে এক্সটেনশন কর্মীরা যে গ্র“প করেছিল আমি এসে দেখলাম তাদের অনেকেই নেই। মাছ চাষও করছে না। ২০০২ সালে এসে আমরা আবার পুনর্গঠিত করলাম। এখন আমাদের প্রধান কাজ হলো গ্র“পগুলোকে ধরে রাখা এবং মাছ চাষে সার্বণিক সহযোগিতা করা। এ বছর থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যারা গ্র“প করবে তাদেরকে প্রকৃতই দরিদ্র হতে হবে এবং আমাদের পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হবে। বৃহত্তর নোয়াখালীর বেশ কিছু অঞ্চল জলাবদ্ধ। এই অঞ্চলে আমরা ধান কাটার পর ধানেেত, বর্ষায় জলাবদ্ধ জমিতে এবং ঘেরে মাছ চাষ শুরু করেছি। বৃহত্তর নোয়াখালীর একোয়াকালচার প্রকল্পের সাফল্যের মধ্যে মূল সাফল্য হলো, আমরা মাছের সাথে গলদা চিংড়ি চাষে অভাবনীয় সাফল্য আনতে পেরেছি। দু’টি গলদা চিংড়ির হ্যাচারী স্থাপন করা হয়েছে। রায়পুরে একটি মৎস্য অভয়াশ্রম রয়েছে ; এদেরকে কোনোরূপ আর্থিক সহযোগিতা না দিয়ে গলদা চিংড়ি চাষের কারিগরি সহযোগিতা করা হচ্ছে। নোয়াখালীতে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। পরবর্তীতে এর সাফল্য আমরা পার্শ্ববর্তী জেলায় ছড়িয়ে দিতে পারবো। তিনি জানান, ‘লোকবলের অভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের উপর অত্যধিক চাপ পড়ছে। একা তিনটি দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।’ তিনি আরো জানান, ‘মৎস্য চাষিদের সরকারিভাবে নানা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে ; জলাবদ্ধ খাস বিশ একরের নীচের জমিকে উন্নয়ন করে মাছ চাষের আওতায় আনা এবং হস্তান্তর করা। প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে এ জলাশয়গুলো পাঁচ বছরের জন্য ইজারা দেয়া হয়। তবে আমরা নিয়মিতভাবে পুকুর পরিদর্শন করছি, জেলার সব পুকুরেই যেন মাছ চাষ করা যায় তার পরামর্শ দিচ্ছি। কিন্তু অনেক েেত্র লোকবলের অভাবে আমরা মৎস্য চাষীদের সময়মতো সহযোগিতা করতে পারি না। কৃষি বিভাগের মতো প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে মৎস্য বিভাগের কর্মী থাকা আবশ্যক।’ নোয়াখালী মৎস্য অধিদপ্তরের সমন্বয়ক দীন মোহাম্মদ মহসীন এ ব্যাপারে খুবই আশাবাদী। তিনি জানান, ‘শুধুমাত্র নোয়াখালী জেলাতেই সমন্বিত মৎস্য চাষের সাথে গলদা চিংড়ি চাষ করলে বছরে আড়াই হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’ নোয়াখালীর জলাবদ্ধ জমিতে গলদা চিংড়ি চাষ শুরু হলে নোয়াখালীবাসীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার দ্রুত উন্নতি হবে। তিনি জানান, ‘আমরা সার্বিকভাবে কৃষকদের এ ব্যাপারে সহযোগিতা করে আসছি। তবে গরিব সম্বলহীন মানুষদের আমরা সহযোগিতা করতে আগ্রহী। ইতিমধ্যেই পরিবেশসম্মতভাবে উৎপন্ন নোয়াখালীর গলদা চিংড়ির প্রতি বিদেশী ক্রেতাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।’ নোয়াখালীর বিপুল সংখ্যক খাসভূমিকে কি করে আরো উৎপাদনমুখী করে সাধারণ ভুমিহীনদের কাছে হস্তান্তর করা যায় তা নিয়ে বিভিন্ন সময় পরিকল্পনা করা হয়েছে। খাসজমিকে মৎস্য উৎপাদনে সমন্বয় করা যায় কিনা সে ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব একোয়াকালচার এন্ড ফিশারিজ-এর প্রভাষক মো. রোকনুজ্জামান জানান, ‘নোয়াখালীর পরিবেশ খুবই বৈচিত্রপূর্ণ। সফলভাবে সঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে দেশ বিপুল ভাবে লাভবান হতে পারবে। বেগমগঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থা একটু নিচু। কিন্তু চর এলাকা অপোকৃত উঁচু। বেগমগঞ্জে যেহেতু লবণাক্ততা নেই অতএব এখানে বাগদা চাষ করা যাবে না। এখানে একমাত্র গলদা চিংড়ির চাষ বেশ লাভজনক হতে পারে। এর সাথে সাথে নানান জাতের মাছের চাষ করে উন্নতি করা সম্ভব। এখানে সামাজিক পরিবেশও খুব উন্নত, তবে নারীরা খুবই রণশীল। কিন্তু তারপরও নারীরা মাছ চাষে এগিয়ে এসেছেন। আমরা যদি কোয়ালিটি ঠিক রাখতে পারি তাহলে বাইরে এর প্রসার ঘটবে খুব দ্রুত। কোনো রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া মাছ চাষ হলে বাইরে বাজার মূল্য হবে অনেক। আশার কথা যে নোয়াখালীর মাটি খুবই উর্বর। ভাইরাস আক্রমণেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। এ অঞ্চলে আর একটা জিনিস লণীয় যে, মাছ চাষের সাথে সমন্বিত চাষও করা যায়। এতে জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার হচ্ছে। কৃষকরাও লাভবান হচ্ছে। এ জমিতে মাছ ছাষের সাথে ধান চাষ চলছে। আবার পাশের চড়া নালায় নেটিং করে লাউ জাতীয় শব্জী এবং উঁচু আইলে নানান প্রকার শব্জী চাষ করা চলে, প্রভাবে একই জমিতে নানান কিছু উৎপাদন করা সম্ভব। আবার সমন্বিতভাবে সমবায় ভিত্তিতে চাষাবাদ করা যায়। যার যার ভূমি অনুযায়ী আনুপাতিক হারে লাভ নেয়া যেতে পারে।’ তিনি আরো বলেন, ‘নোয়াখালীতে নারীদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতা একটু বেশি। এটা দূর করতে পারলে সমাজ অনেক এগিয়ে যাবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের ড. কাউছার আহমেদ বলেন, ‘আমরা অনেকেই জানি যে প্রাকৃতিক বনায়ন ধ্বংস করে বাগদা চিংড়ি চাষ করে সুন্দরবন তিগ্রস্ত হয়েছে। চকোরিয়াতে পরিবেশ বিধ্বংসী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে নোয়াখালীতে গলদা চিংড়ির যে পরীামূলক চাষ হচ্ছে তাতে তেমন কোনো তি হচ্ছে না বললেই চলে ; এখানে মিঠা পানিতে গলদা চিংড়ি হচ্ছে আবার তার সাথে অন্যান্য মাছও চাষ হচ্ছে। নোয়াখালীর দেিণ যে নতুন চর জাগছে তাতে বাগদা চিংড়ির বদলে গলদা চিংড়ির চাষ করাই উত্তম। নোয়াখালীর জলাবদ্ধ জমি ও অব্যাহৃত পুকুরে যে ল ল টাকার মাছ ও গলদা চিংড়ির চাষ হচ্ছে তা অর্থনৈতিক সুফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি। বাগেরহাট এবং চকোরিয়াতে যেভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে নোয়াখালী তার একেবারে বিপরীত। এখানে পরিবেশকে তিগ্রস্ত না করেই গলদা চিংড়ি চাষ করে ঐ অঞ্চল থেকেও অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের অপর এক প্রভাষক মাহমুদ হাসান জানান, ‘জিএনএইপি-এর প্রজেক্ট করার প্রধান রিসোর্স নোয়াখালীর পুকুর। এ অঞ্চলে ল ল পুকুর রয়েছে, আবার বিশুদ্ধ পানি রয়েছে। মিঠা পানির গলদা চিংড়ি খুবই পরিবেশ বান্ধব। এখানে ঐ বড় বড় পুকুরগুলোতে গলদা চিংড়ি চাষ করলে অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধিত হওয়া সম্ভব। আমার মনে হয়, সঠিক পরিকল্পনা করতে পারলে আগামী পাঁচ বছরে নোয়াখালীর চেহারা বদলে যাবে। দ্রুত লাভের মানসিকতা বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে পরিবেশসম্মতভাবে পুকুরগুলোকে ব্যবহার করতে হবে। এ চাষ যাতে দীর্ঘস্থায়ী করা যায় তার দিকে নজর দিতে হবে। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবার মধ্যে বিশ্বাস রাখতে হবে। সৎ হতে হবে। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকতে হবে। যে কোনো ব্যাপারে আমরা যদি একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধ থাকি তাহলে আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবো। অনেক সমস্যার সমাধানও আমরা করতে পারবো’। নোয়াখালীর দেিণ যে বড় বড় চিংড়ি ঘের করার আত্মঘাতি পরিকল্পনা করা হচ্ছে সে ব্যাপার তিনি জানান, ‘সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য ছোট ছোট প্রকল্পই সুবিধাজনক। যত ছোট প্রকল্প হয়, ম্যানেজমেন্ট তত সহজ হয়।’
নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলে যে বিপুল পরিমাণ খাস ভূমি জেগে উঠছে তা যেন পরিকল্পনাহীন ভাবে অনুৎপাদনশীল না থাকে। আমাদের যেমন আছে প্রাকৃতিক সম্পদ, তেমনি আছে বিপুল সম্ভাবনাময় মানুষ। সেসব মানুষকে কাজে লাগিয়ে ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। খাসজমি পাওয়ার একমাত্র অধিকার রয়েছে ভূমিহীনদের। ভূমিহীনদের নামমাত্র ভূমি বরাদ্দ দিয়েই দায়িত্ব শেষ করা যাবে না। ভূমিহীনদের এমনভাবে জমি বরাদ্দ দিতে হবে যেন তারা সে জমি থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পায়, উৎপাদন করতে পারে। একজন ভূমিহীন একই ঘেরের মধ্যে থেকে ধান চাষ, মৎস্য চাষ, বনায়ন, শব্জী চাষ, হাঁস-মুরগী ও গবাদী চাষের মাধ্যমে বাড়িকে কি করে উৎপাদনমুখী করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। চিংড়ি ঘেরের নামে ভূমিহীনদের বঞ্চিত করে সুবিধাভোগীরা ভূমি লুটেরা চক্র যে পরিকল্পনা নোয়াখালীর উপকূলে শুরু করেছে তা দেশের জন্য কোনো অবস্থাতেই মঙ্গল বয়ে আনবে না। ভূমিহীনদের মধ্যে খাসজমি বন্দোবস্ত দিয়ে সে জমিতে মৎস্য চাষের পরিকল্পনা করতে হবে। এ বিষয়ে ভূমিহীনদের কারিগরি দক্ষতা তৈরি ও বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করাও অপরিহার্য।
মাহমুদুল হক ফয়েজ
ম্যস লাইন মিডিয়া সেন্টার(এম এমসি) কতৃক ফেলোশিপের আওতায় এই রিপোর্টগুলো তৈরী করা হয়েছে।
--Foez 06:50, 13 January 2010 (UTC)