মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর প্রথম দেয়াল পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’

'মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর প্রথম দেয়াল পত্রিকা'

মুক্তিযুদ্ধে নোয়াখালীর প্রথম দেয়াল পত্রিকা

‘স্বাধীনতা’

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার অনেক আগ থেকেই নোয়াখালীতে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। সত্তুরের ১২ই নভেম্বর ইতিহাসের বিভিষিকাময় জলচ্ছাসে নোয়াখালীর উপকূল ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরান অঞ্চলে পরিনত হয়। মৃত্যুর হীম শীতল কোলে চলে পড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ। সে সময় পাকিস্তান সরকারের অবহেলায় দীর্ঘদিন ধরে পঁচা গলিত লাশ উন্মুক্ত চরে পড়েছিল। সে অবস্থায় স্থানীয় রাজনৈতিক সাংস্কুতিক সামাজিক সংগঠনের শত শত কর্মী অমানুষিক পরিশ্রম করে দিন রাত চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিধ্বস্ত উপদ্রুত মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বস্তুত তখন থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ সিদ্ধান্ত নিল ওদের সাথে আর নয়। সারা বাংলার মত নোয়াখালীর জনগণও তৈরী হতে থাকে স্বাধীনতার জন্য। প্রায় প্রতিদিনই মিছিল মিটিং হতে লাগলো। ৭১ এর মার্চের প্রথম দিকেই দেশ যেন চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হলো। মিছিলে মিছিলে স্লোগান উঠলো মুক্তি আসে কোন পথে টঙ্গি ঢাকার ঐ পথে। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর সোনার বাংলা স্বাধীন কর’। শেখ শেখ শেখ মুজিব লও লও লও সালাম।

আমরা ছিলাম কচি-কাঁচার মেলার সদস্য। বেলায়েত ভাই, চানধন ভাই, তাহের ভাই, ফজলু ভাই, মিজান ভাই আর চির তরুন কাজী মাহফুজুল হক ছিলেন আমাদের পরম পূজনীয় ব্যক্তিত্ব। সবার প্রিয় কাজী মাহফুজুল হক কে সবাই ডাকতো ‘মাধু চাচা’ তিনি মৌমাছি কচিঁ কাঁচার মেলার পরিচালক। আমরা ডাকতাম ‘দাদু’। আমাদের নিয়মিত চলতো সাহিত্য সভা। জননেতা আব্দুল মালেক উকিল তার একটি ঘর আমাদেরকে ব্যবহারের জন্য দিয়ে ছিলেন। হরিনারায়ণপুর স্কুলের পাশে ছিল আমাদের সেই অফিস ঘর। মৌমাছি কচিঁ কাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক বেলায়েত ভাই (মাহমুদুর রহমান বেলায়েত) রব ভাই (আ.স.ম আব্দুর রব) তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া নানা বইতে আমরা সাজিয়েছিলাম লাইব্রেরী। বড় একটি কাঁচের আলমারি ঘিরে ছিল আমাদের সেই লাইব্রেরী। প্রতিদিন আলমারীর ডালা খুলে বইয়ের মদির গন্ধ নাকে না লাগালে আমাদের দিন যেত না। স্কুল ছুটির পর ছুটে যেতাম অফিসের লাইব্রেরীতে। সাহিত্য সভায় দাদু আর বেলায়েত ভাই শোনাতেন স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য বিভিন্ন দেশের মুক্তিকামী মানুষের কথা। নানান দেশের নানান গল্পে তাঁরা আমাদের ধরে রাখতেন। আমরা তন্ময় হয়ে শুনতাম। কাজী মাহফুজুল হক দাদু ছিলেন সার্জেন্ট জহুরুল হকের চাচা। সার্জেন্ট জহুরুল হকের গল্প বলতে বলতে তিনি উদাস হয়ে পড়তেন। স্বাধীনতার জন্যও তিনি যেন মরিয়া হয়ে উঠে ছিলেন। নিয়মিত সাহিত্য সভা আমাদের জন্য এক শিক্ষনীয় বিষয়ে পরিনত হয়ে উঠেছিল। সেখানে আমরা একটি দেয়াল পত্রিকা বের করতাম। নাম ছিল ‘কৃষ্ণচূড়া’। সেটির দ্বায়িত্বে আমারই ছিল। নানা কচি হাতের লেখায় ভরে থাকতো সেই পত্রিকা। মাঝে মাঝে অবশ্য ছোট আকারের মিনি ছাপার পত্রিকা বের হোত। খরচও বেশী ছিল না। শরীয়ত প্রেস, হিতৈষী প্রেস, ইসলামিয়া প্রেস ছিল আমাদের জন্য খোলা। মৌমাছি কচি- কাঁচার মেলার সেই অফিস ঘর ছিল আমাদের সাহিত্য চর্চার সূতিকাগার। পরে পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশ করলে আমাদের সেই অফিস ঘর লুঠ হয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় আমাদের প্রিয় সব বই গুলো।

৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষনের পর শুরু হলো স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি। একদিন বিকালে মমিন ভাই (আলহাজ্ব এডভোকেট মমিন উল্যাহ) আমাকে প্যারামেডিকেলের একপাশে ডেকে অত্যন্ত গোপনে একটি কাগজ ভাঁজ করে দেখালেন। সেই কৈশোর বয়সে দারুন উত্তেজনা আর উল্লাসে যেন ফেটে পড়লাম। দেখালাম সেটি স্বাধীনতার ইস্তেহার। তিনি আরো দেখালেন সোনালী বাংলাদেশ অঙ্কিত লাল সবুজ পতাকা। উত্তজনায় সারা শরীর তখন কাঁপছিল। ফিস ফিস করে বল্লেন একটি সর্বাত্তক সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য তৈরী হচ্ছে সবই। ঢাকা থেকে গোপন নির্দেশ এসে গেছে। তখনও প্রতিনিয়ত চলছিল মিছিল আর মিটিং। মিছিলে অগ্রভাগে প্রায়ই থাকতো সাকী আপা (ফরিদা খানম সাকী), আলেয়া (শিরিন জাহান দিলরুবা) আর্জুমান্দ বানু (প্রাক্তন মহিলা সংসদ) রেহানা বেগম (চৌমুহানী গনিপুর গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা) সহ অনেকে)। মেয়েরা যে প্রস্তুতি নিচ্ছে তাই বুঝা যেত। মিছিলে আরো অনেক মেয়ে ও ঘরের বঁধুরা থাকতো। মিসেস সূধা, (নেহালের আম্মা), বকুল আপা (মিসেস বোরহান), খায়রুন নাহার (মিসেস বাকের) মিসেস শফী, পারুল, বকুল সহ আরো অনেকে মাঝে মাঝে মহিলাদের অনেক বড় মিছিল হতো। আমরা মিছিলের কখনো সামনে কখনো মধ্যে বা পিছে থেকে স্লোগান দিতাম ‘মা বোনেরা অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। মাথায় থাকতো লাল সবুজ রঙের ফিতে। কাশেম (জি.এস কাশেম), শাহাজাহান (মিয়া মোঃ শাহাজাহান) বাবর (মাননীয় মন্ত্রী আ.স.ম রবের পি এস) হাছান, নোমান, কাজল, কাঞ্চন সহ আমাদের সঙ্গে ছিল অনেক খুব কিশোর কর্মীরা। সবাই মিলে নিজেরা ঠিক করলাম স্বসস্ত্র যুদ্ধের আগে ট্রেনিংতো নিতে হবে। লেফট রাইটতো শিখতে হবে প্রথম। ভারতে গিয়ে কোন ট্রেনিং নিতে হবে তা কারো কল্পনাই আসে নি।

আমি ছিলাম স্কুলের জুনিয়র ক্যাডেট কোরের ব্যান্ড পার্টির কমান্ডার। সদস্য সংগঠিত করে ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্বটিও বর্তালো আমার উপর। তখন সম্ভবতঃ ১০ই মার্চ থেকে জর্জকোর্টের উত্তরে দিঘির পাড়ে শুরু হলো প্রাথমিক ট্রেনিং। লাঠি ছিল আমাদের বন্দুকের বিকল্প। কাশেম, শাহাজাহান, বাবর, কাজল, কাঞ্চনসহ প্রায় ২৫/৩০ জনের একটি দল লেফট রাইট শেখা আর লাঠি দিয়ে তৈরী হলো সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য। ২৬শে মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন বিকালে সে ট্রেনিং চলতো। ২৬শে মার্চের পর যতদিন নোয়াখালী শহর মুক্ত ছিল, জিলা স্কুলে সামরিক বাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত সুবেদার, পরে পি.টি আইতে স্থনান্তরিত হয়। ট্রেনিং শুরু করেছিলেন সেখানে। ২৩শে মার্চ’৭১ ছিল নোয়াখালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক স্মরনিয় দিন। সেদিন বিকালে কাছারী ময়দানে (বর্তমানে পাবলিক হেলথ্ ও সড়ক ও জনপথ বিভাগের অফিস) এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভা মূলতঃ মমিন উল্যা ভাইয়ের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয়। তখনকার ছাত্র নেতা বর্তমান আওয়ামীলীগ নেতা সেখানেই সোনালী বাংলাদেশ অংকিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। সেটিই ছিল নোয়াখালীর সর্ব প্রথম আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন।

এলো ২৬শে মার্চ। পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিত আক্রমন করলো ঢাকার নিরস্ত্র মানুষের উপর। তরিৎ খবর এলো নোয়াখালীতে। সারা শহর থম থমে। গভীর রাতে একটি ক্ষিন কন্ঠে মৃদু শব্দের একটি মাইক থেকে শহরে কয়েকটি জায়গায় রিক্সা দিয়ে ঘুরে ঘুরে কে যেন অবিরাম বলে যাচ্ছে ‘বঙ্গ বন্ধুর নির্দেশ এসেছে, ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করছে, স্বাধীনতা যুদ্ধে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ুন’। আমি অকুতভয় সেই কন্ঠ দীর্ঘদিন খুঁজে ফিরেছি, কে সেই নিভৃত সাহসী মানুষ যে সেদিন ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে নোয়াখালী শহরের ঘুমন্ত মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সেই স্বাধীনতার ঘোষনা ও নির্দেশ। আমার মত সেদিন অনেকেই শুনেছিল মাইকের সেই ঘোষনা। কিন্তু নিভৃতচারী সেই মানুষটি আর কখনোই প্রকাশিত হলো না। তার নাম আর পরিচয় দীর্ঘদিন কেউ জানতে পারে নি। দীর্ঘদিন পর জানা গেছে তিনি তৎকালিন ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আবুল কাশেম। বর্তমানে তিনি নোয়াখালী পৌর সভায় কর্মরত আছেন। ২৫শে মার্চ রাত ১২.০০ টার পর বঙ্গ বঙ্গুর কাছ থেকে স্বাধীনতার খবর আসলে জননেতা আবদুল মালেক উকিলের বাসা থেকে তারা মাইকিং করেন।

সে সময় নোয়াখালী টাউন হলে প্রতিষ্ঠিত হলো মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তর। ২৭/২৮ শে মার্চেই শুরু হলো ফেনীতে যুদ্ধ। ফেনী ছিল তখন বৃহত্তর নোয়াখালী জেলার একটি মহকুমা। শত শত পুলিশ আনছার যুবক আর সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত প্রাত্তন সৈনিকেরা নাম লেখাতে লাগলো মুক্তিবাহিনীতে। শত শত তরুন বিশেষ করে আনছার ও পুলিশ যুদ্ধে যাবার জন্য উদ্গ্রীব ছিল। ট্রাকে করে তারা যাত্রা করে ফেনীর উদ্দেশ্যে। সে সময় এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা হয়েছিল। মুক্তি যোদ্ধাদের জন্য রুটি বানিয়ে গাছের ডাব নিয়ে শত শত গ্রাম বাসী টাউন হলে নিয়ে আসছিল। টাউন হলের মেঝে হাজার হাজার রুটিতে সয়লাব হয়ে গিয়েছিল তখন। মানুষের চোখে মুখে ফুটে উঠলো এক দৃঢ় প্রত্যয় কেমন করে হানাদার বাহিনীদের তাড়িয়ে বাংলাদেশের বিজয় ত্বরাম্বিত হবে। এ সব কিছুই ঘটছিল আমাদের চোখের সামনে। আমি তার বন্ধু নেহাল ঠিক করলাম এ অবস্থায় আমরা একটি দেয়াল পত্রিকা বের করবো। যেই কথা সেই কাজ। নাম রাখলাম ‘স্বাধীনতা’। বি.বি.সি, স্বাধীন বাংলা বেতার, আকাশবানী সহ পৃথিবীর অন্যান্ন বেতার থেকে পাওয়া মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ আর নিজেদের পাওয়া খবর দিয়ে সাজানো হলো পুরো পত্রিকা। থাকতো নানা জনের লেখা। থাকতো কন্ট্রোল রুমের প্রতিদিনের ইশতেহার। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র তখন থেকেই ছিল সক্রিয়। পত্রিকার নীচে আমাদের সংক্ষিপ্ত নাম রাখলাম মাহফ ও নেসি। প্রতিদিন একটি করে পত্রিকা লিখে টাউন হলের মোড়ে চৌধুরী মিয়ার পানের দোকানের পাশে একটি বোর্ডে টাঙ্গিয়ে রাখতাম। খবর কাগজ হীন মুক্তি যুদ্ধের শুরুর দিন গুলোতে হাতের লেখা সেই দেয়াল পত্রিকা দারুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। প্রতিদিন শত শত উৎসুক মানুষ সে পত্রিকা এসে আগ্রহের সঙ্গে পড়তো। দু’ চার দিন পর আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন শিল্পী মফিজল হক। মৌমাছি কচিঁ-কাঁচার মেলার শিল্প বিভাগের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। ফকিরপুরে ‘শিল্পাঙ্গন’ নামে একটি চিত্র শালা ছিল তার। স্বভাবে ছিলেন অত্যন্ত নম্র ও শান্ত। স্ব-প্রতিভাধর শিল্পী। তাঁর প্রতিটি তুলির আঁচড়ে ছিল স্বাধীনতা ও দেশ প্রেমের নিবিড় স্পর্শ। ক্যানভাসে তিনি প্রতিদিন আঁকতেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নানা চিত্র। আমরা সেই চিত্র পত্রিকার বোর্ডের পাশে টাঙ্গিয়ে রাখতাম। টিক্কা খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা প্রধান হল, শিল্পী একটি চিত্রে আঁকলেন একজন কৃষক বসে মহা সুখে হুক্কা টানছে সেই হুক্কার উপর জ্বলন্ত কলকিতে টিক্কার মত জ্বলছে পাকিস্তানের সেই জেনারেল টিক্কাখান। টিক্কা হলো হুক্কায় তামাক সাজানোর জন্য বিশেষ ভাবে তৈরী কয়লার ছোট ছোট চাকতি। প্রকারান্তরে তিনি হক্কার কলকিতে জ্বলন্ত টিক্কাকে ‘টিক্কা খান’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন যা বাংলার এক কৃষক মহাসুখে দম মেরে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। কি অপূর্ব কল্পনা শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বাংলার মুক্তিকামী সর্বস্তরের সাহসী কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতা সেই প্রতিকী চিত্র শিল্পের মতই পরবর্তীতে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। আরেকটি চিত্র ছিল এক হিংস্র শকুন এক ছোট্ট শিশুর কলজে ছিঁড়ে খাচ্ছে, শিশুটির বুক থেকে টক টকে লাল রক্ত ফোঁটা ফোঁটা ঝরে পড়ছে। অদূরে উদ্ভ্রান্ত মা আর্তনাদ করে মরছে। ছোট্ট শিশুকে আমাদের স্বাধীনতা, হিংস্র শকুন পাকিস্তানী বাহিনী আর মাকে আমাদের বাংলা ‘মা’ কেই বুঝানো হয়েছিল। এই রকম অসংখ্য চিত্র শোভা পেত সেখানে। শত শত মানুষ দেখতো আর উদ্ভুদ্ধ হতো স্বাধীনতার প্রতি। কথায় আছে একজন সৈন্য একজন সৈন্যই, সেই সৈন্যদের উৎসাহ দাতা একজন শিল্পী হাজার সৈন্যের সমান। স্বাধীনতার পর তার কিছু শিল্প কর্ম নিয়ে আমরা সাতদিন ব্যাপী একটি প্রদর্শনী করেছিলাম। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই প্রতিভাধর শিল্পীর কথা আমরা এখন আর কেউ স্মরন করি না। স্বাধীনতা আন্দোলনের সেই মহান চারন শিল্পী স্মৃতির অতলেই হারিয়ে গেল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার শিল্প কর্মগুলো সংরক্ষনের জন্য নানাজনের কাছে ধর্না দিয়েও কিছুই করতে পারেননি তিনি।

২৩/এপ্রিল’৭১ তারিখ পর্যন্ত নোয়াখালী শহর ছিল শত্রু মুক্ত। দশ/বার তারিখ থেকেই প্রতিদিন গুজব আসতো হানাদার বাহিনী সব কিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শহরের দিকে আসছে। কিন্তু আমরা পত্রিকা লেখা বন্ধ করিনি। পত্রিকা টাঙ্গিয়ে আমরা পাহারায় থাকতাম। ১৯/২০ তারিখে হঠাৎ দেখা গেল প্রধান সড়ক দিয়ে উত্তর দিক থেকে কয়জন মানুষ দৌড়ে আসছে। সবাই ভাবলো হানাদার বাহিনী প্রবেশ করছে শহরে। শিল্পী মফিজল হক তার টাঙ্গানোচিত্র গুলো নিয়ে গোল করে গুটিয়ে বগলে নিয়ে রাস্তার একপাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। দেখলাম তাঁর শিল্প গুলোকে বাঁচাবার জন্য তার কি ব্যকুলতা। কিছুক্ষন পরে জানা গেল, সবই গুজব কিছুই নয়। একটু পরে তিনি সেই ছবি গুলোকে আবার টাঙ্গিয়ে দিলেন। অবশেষে ২২শে এপ্রিল হানাদার বাহিনী বহু নৃসংশতার মধ্যে শহরে প্রবেশ করে। তার আগেই আমরা পত্রিকাগুলোকে বেঁধে বিভিন্ন জায়গায় রেখে দেই। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে শিল্পী মফিজল হকের অনেক অমর শিল্পের সঙ্গে সেই পত্রিকাগুলোও হারিয়ে যায়।

স্বাধীনতা আমাদের দেশে হঠাৎ কোন দৈব প্রাপ্তি নয়। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে এর জন্য ছিল বিপুল আয়োজন। নোয়াখালীর এ অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষেরাও তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল স্বাধীনতার গৌরবময় এক একটি অধ্যায়। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনেই সেই সব ছোট ছোট স্মৃতি গুলো লিপিবদ্ধ করা আজ খুবই প্রয়োজন। দুঃখ হয় যারা স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী ছিল রাজাকার আলবদরদের দোসর ছিল, তারা আজ নানা রূপ ধরে সরল সাধারন মানুষদের বিভ্রান্ত করছে। তারা এতই চতুর আর ধূর্ত যে প্রশাসন আর রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী শ্রেনীর মানুষজনদেরও চোরাবালিতে আটকে ফেলছে। আর অবহেলা অযত্নে রাস্তার একপাশে বুনোগুল্মের মত পড়ে আছে যারা জন্মাবধি এদেশ মাটিকে ভালবেসে জীবনের সকল প্রলোভনকে উপেক্ষা করে উৎসর্গ করেছে নিজেকে।

সবকিছু বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবার আগেই আমাদের মহান স্বাধীনতার ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় গুলো খুঁজে বের করতে হবে।

মাহমুদুল হক ফয়েজ

সাংবাদিক, গবেষক

প্রকাশিত লোক সংবাদ

--Foez 17:32, 2 June 2013 (UTC)