মুক্তিযুদ্ধকালিন নোয়াখালীর কয়টি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ

From WikiEducator
Jump to: navigation, search






মুক্তিযুদ্ধকালিন নোয়াখালীর কয়টি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ


মুক্তিযুদ্ধকালিন নোয়াখালীর কয়টি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ

মাহমুদুল হক ফয়েজ</Font.>


বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস্, সারা দেশের মত নোয়াখালীতেও অসংখ্য হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। সে সব হত্যাযজ্ঞের অনেক কাহিনী আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও নোয়াখালী বাসীর অনেকের মনে সে সব স্মৃতিগুলো সকরুণ নিনাদে আজও গুমরে গুমরে কেঁদে উঠে। একাত্তরের ২৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনী ব্যাপক নৃশংসতার মধ্যে নোয়াখালী শহরে প্রবেশ করে। তার আগে তারা নোয়াখালীর অন্যতম ব্যবসা কেন্দ্র চৌমুহনীবাজার জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সে সময় তারা হত্যা করে অসংখ্য মানুষকে। তাদের সে হত্যাযজ্ঞের দোসর হয়েছিলো রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ আর কিছু জামাত মুসলীমলীগ পন্থী খুনি চক্র। সে সময় তারা নোয়াখালীতে বেশ কয়টি ক্যাম্প স্থাপন করেছিলো। সে গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো বেগমগঞ্জ চৌরাস্তায় ট্যাকনিকেল স্কুল, মাইজদী পিটিআই ভবন ও সে সময়ের নির্মিতব্য নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতাল ভবন। এসব ক্যাম্পে তারা অনেক নিরিহ মানুষকে ধরে এনে হত্যা করেছিলো।

হানাদার খুনি চক্র প্রথমেই শহরে প্রবেশ করে কিশোর জসিমকে হত্যা করে। মাইজদী শহরের ফকিরপুর এলাকায় থাকতো তারা। সে এলাকায় তখন ছিলো স্বাধীনতা বিরোধীদের আড্ডা খানা। তখন জসিমের বয়স ছিলো মাত্র তের চৌদ্দ বছর। তার অপরাধ ছিলো সে তার সমবয়সি বন্ধুদের সাথে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মাঝে মাঝে বিভিন্ন মিছিলে থাকতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম ভাগেই সেই স্বাধীনতা বিরোধী খুনি চক্র জসিমকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। সে ক্যাম্পেই জসিমকে অমানুষিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। শহীদ নৃপেন পাল ছিলেন নোয়াখালী পৌরসভার জনপ্রিয় কমিশনার। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রামে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। সে সময় ১৫বৈশাখে তাঁর ছোট ভাই শিবেন্দ্র কুমার পালকে নিয়ে মাইজদী আসেন। তাঁদের আসার খবর পেয়ে মাইক লাতু সহ একদল রাজাকার তাঁর বাড়ি থেকে তাদের দু’ভাইকে ধরে বেঁধে পিটিআই ভবনে পাকিস্তানীদের ক্যাম্পে নিয়ে যায। সেখানে অকথ্য নির্যাতনের পর হত্যা করে তাদের দুজনকে ক্যাম্পের পাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। সেময়ের একটি করুণ ঘটনা পার্শবর্তী গ্রামবাসীদের হৃদয় নাড়া দিয়ে যায়। শহীদ নৃপেন কুমার পালের ছিলো লালু নামের একটি পোষা কুকুর। নৃপেনকে যখন ধরে নিয়ে যায় লাল্ওু তখন তাদের পিছনে পিছনে ছুটে যায়। নৃপেন পালকে যেখানে মেরে পুঁতে রাখা হয়েছিলো সে মাটির স্তুুপের উপর মাথা রেখে লালু আর্তচিৎকার করতে থাকে। কেউ তাকে সেখান থেকে সরাতে পারেনি। কারো দেয়া খাওয়াও সে খায়নি। এ ভাবে বিলাপ করতে করতে কয়দিন পর সেখানেই লালু মরে পড়ে থাকে। গ্রামের মানুষ প্রত্যক্ষ করল এক প্রভুভক্ত বোবা জীবের প্রাণ উৎসর্গ করা ভক্তি অর্ঘ। শহীদ নগেন্দ্র কুমার শূর ছিলেন নোয়াখালীর স্বনামধন্য উকিল। জেলা বাসী তাঁকে স্বম্মান করে সম্বোধন করতেন রায় সাহেব বলে। নোয়াখালীর বিভিন্ন সমাজিক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান উদ্দোক্তা। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্র সৈনিক। অসম্ভব বাকপটু এই মানুষটি ছিলেন সবার প্রিয় ব্যাক্তিত্ব। তাঁর এক ছেলে প্রশান্ত কুমার শূর ছিলেন সে সময়ের কলকাতার মেয়র। ২২ সেপ্টেম্বর চৌমুহনী শান্তি কমিটির নির্দেশে রাজাকার কমান্ডার আবুল কাশেম এর নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক রাজাকার আশিতিপর বৃদ্ধ রায় সাহেবকে তাঁর রসুলপুর গ্রামের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সে ক্যাম্পের শান্তি কমিটির খন্দকার আতাউর রহমান, জামায়াতে ইসলামের প্রফেসর মহিউদ্দিন, পিডিপির এডভোকেট সিদ্দিক উল্লাহ্, কাউন্সিল মুসলিম লীগের ছাইদুল হকের নির্দেশে তাঁকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানী মেজর ইমতিয়াজের হাতে তুলে দেয়। ২৪ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পে তাঁকে অকথ্য নির্যাতন করে হত্যা করে জল্লাদ বাহিনী। রায় সাহেবকে যেদিন হত্যা করা হয়েছিলো সেদিন মুক্তিযুদ্ধের আর এক সংগঠক সুলতান মাঝি সহ মোট সাত জনকে হত্যা করে মাটি চাপা দেয় ঘাতকেরা। স্বাধীনতার পর পরই তাঁর হত্যাকান্ডের জন্য আদালতে মামলা হয়েছিলো। পরবর্তীতে নানান ঘটনায় সে মামলা চাপা পড়ে যায়।

নোয়াখালী পৌর বাজারে একটি মুদি দোকানের ব্যাবসায়ী ছিলেন চিত্ত রঞ্জন সাহা। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাড়ির সবাইকে নিয়ে তিনি শহরের পার্শবর্তী গ্রাম হাসান হাটে চলে যান। ১০ মে তিনি শহরের অবস্থা দেখার জন্য মাইজদী আসেন। খবর পেয়ে ঐদিন সকালে চৌমুহনীর আলু জালাল, গোলাপ মিয়া সহ কয়জন শান্তি কমিটির লোকজন সহ পাকিস্তানী সৈন্যরা তার বাড়ি ঘিরে তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। সে দিন রাত্রে তাঁর উপর চলে অকথ্য নির্যাতন। পর দিন পাকিস্তানী সৈন্যরা একটি খোলা জীপের পিছনে তাঁকে লম্বা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে মাইজদী চৌমুহনীর রাস্তায় ছেঁচড়িয়ে টেনে নিয়ে যায়। এ অবস্থায় এবড়োথেবড়ো রাস্তায় দ্রুত জীপ চালানোর ফলে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। খসে খসে পড়ে শরীরের মাংস। যতক্ষণ পর্যন্ত তার মৃত্যু না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এ ভাবে জীপ চালিয়ে নিয়েছিলো। এক সময় শরীর নির্জীব নিথর হয়ে এলে তার মৃতদেহ রাস্তার পাশে ফেলে দেয় ঘাতকেরা। সে দেহটি কুকুর শিয়ালের খাদ্য হিসাবে রাস্তার পাশেই পড়েছিলো। একটি জীবন্ত তাজা মানুষকে মধ্যযুগীয় কায়দায় কী ভীষণ নৃশংসতায় এ ভাবে হত্যা করা হয়েছিলো আজ তা ভাবতেও গা শিহরিত হয়ে ঊঠে।

ছায়াঘেরা একটি শান্ত স্নিগ্ধ গ্রাম সোনাপুরের শ্রীপুর। একাত্তরের ১৫ জুন এ গ্রামের উপর নেমে এসেছিলো এক গভীর রক্তাক্ত অমানিশা। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এ গ্রামের উপর অতর্কিত হামলে পড়ে। সে দিন এ গ্রামকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে বিরান করে দেয় তারা। অত্যাধুনিক মেশিনগান দিয়ে গুলি করে এ গ্রামের শতাধিক মানুষকে হত্যা করে পিশাচরা। যুদ্ধ শুরু হলে অনেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে এ গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সে দিন হানাদারদের জ্বলিয়ে দেয়া আগুনে অনেকেই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অনেকের চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ হত্যাযজ্ঞ ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকানদের মাইলাই হত্যাকান্ডকেও ম্লান করে দেয়। আগষ্টের ১৯ তারিখে চৌমুহনী লক্ষীপুর সড়কের পাশে গোপালপুরে হানাদারদের মেশিনগানের গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিলো ৬৫ জন নিরিহ গ্রামবাসী। সেদিন গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে অনেক গ্রামবাসী গোপালপুর বাজারে এসে তাদের স্বভাবসিদ্ধ গল্পগুজব করছিলো। সেসময় বাজারের দুদিক থেকে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা এসে পুরোবাজার ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা যাদেরকে পেয়েছে তাদের সবাইকে ধরে এনে বাজারের পাশে খালের পোলের উপর এনে দাঁড় করায়। এর পর তারা একেএকে ব্রাশ ফায়ার করে নিরিহ মানুষদের হত্যা করে খালের পানিতে ফেলে দেয়। সেদিন গ্রামবাসীদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায় সে খালের পানি ।

জুন মাসের কোনো একদিন হানাদার বাহিনী ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে এনেছিলো। এদের মধ্যে একজন কিশোরও ছিলো। তাদের সবাইকে পিছনে হাত ও চোখ বেঁধে ট্রাকে করে এনে দাঁড় করায় মাইজদী শহরের প্রধান কেন্দ্র পোষ্টঅফিস মোড়ে। এদের সঙ্গে খোলা জীপে করে এসেছিলো পাকিস্তানী মেজর ইমতিয়াজ এবং রাজাকার কমান্ডার তৎকালীন এনএসএফ নেতা বর্তমানে প্রয়াত আবু সুফিয়ান। সে সময় তাদেরকে দেখতে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিলো। তখন জনতাকে উদ্দেশ করে তারা বলেছিলেন, ‘এরা ভারতের চর ইসলামের শত্র“’। উর্দ্দুতে ভাষণ দিয়েছিলো মেজর ইমতিয়াজ। বলেছিলেন,‘ইসলাম জিন্দা রহে হার কারবালা কি বাদ, আওর পাকিস্তান জিন্দা রহেগা হার পাকিস্তান হিন্দুস্তান জঙ্গ কি বাদ’। অর্থাৎ ইসলাম বেঁচে আছে কারবালা যুদ্ধের পর আর পাকিস্তান বেঁচে থাকবে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের পর। এক পর্যায়ে আবু সুফিয়ান কোমর থেকে দুই হাতে দুইটি পিস্তল বের করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে তাক করে সমবেত জনতাকে বলেছিলেন, ‘আপনারা যদি বলেন এদেরকে এখানেই গুলি করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করবো’। তখন সেখানে অনেকেই মুখ লুকিয়ে ফেলেছিলেন। সবাই সমস্বরে বলে ঊঠলেন, ‘না না না’ । পরে তাদেরকে সেখান থেকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করা হয়।

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সমগ্র দেশের মত এ সব হত্যাযজ্ঞগুলোর সমান্যই এখানে উদ্ধৃত করা হলো। পুরো যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসররা সমগ্র জেলাতেই মানবতা বিরোধী অসংখ্য নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। সে সবের অনেক কিছুই আজ বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। সে সব খুনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত ছিলো তারা নানান কুটকৌশলে পার পেয়ে যায়। অনেকেই পরবর্তীতে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছে। অনেকেই রাজনীতির ছত্রছায়ায় লাখ শহীদের রক্তস্নাত এই পবিত্র দেশে বহাল তবিয়তে দিনযাপন করছে। মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, এ জাতি তাদের রক্তঋণে আবদ্ধ হয়ে আছে। যাঁরা হারিয়েছেন আপন জন। তাঁদের সে প্রিয়জন হারানোর কষ্টগুলো বেদনাবিধুর হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে কেউ অনুভব করতে পারবেনা। সে বেদনার অগ্নি অল্প সময়ে নিভে যাবেনা। যতদিন বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে সে বেদনাও ধিকিধিকি জ্বলতে থাকবে।

আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি উঠেছে । যারা খুনি, মানবতা বিরোধী কর্মকান্ডে জড়িত ছিলো, তাদের বিচার না হলে মানবতাও ভুলুন্ঠিত হবে। বিচারের কাঠগড়ায় তাদেরকে তুলতে না পারলে মৃত্যু হবে মানব সত্তার।


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

গবেষক, গণমাধ্যম কর্মী


Foez 11:50, 31 December 2009 (UTC)