বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি

From WikiEducator
Jump to: navigation, search


ফিচার



'বুড়ো আলী আজ্জমের মচমচে মুড়ি


মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

বৃদ্ধ আলী আজ্জম। এই বয়সেও সারাদিন হেঁটে হেঁটে বিক্রি করেন মুড়ি । নিজের উপর অগাধ বিশ্বাস তাঁর। নিজে যা পারছেন তাই করছেন। বয়স নব্বই ছাড়িয়ে গেছে। শরীরের চামড়াগুলো থলথলে, ভাঁজ পড়েছে অসংখ্য। পায়ে চপ্পল। পুরনো হয়ে গেছে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাতলা হয়ে গেছে অনেকটা। চলতে চলতে চপ্পল মৃদু শব্দ ওঠে। গায়ে আধময়লা গেঞ্জি। এক পাশটা ছিড়েঁ ঝুলে পড়েছে অনেকটা। মাথায় বেশ বড় বড় ঢাউস বস্তা। মাইজদীর এই মফস্বল শহরে ভাঙ্গাগলি মাড়িয়ে টানা টানা স্বরে হাঁক দেন - ‘মুড়ি.ই.ই.ই.ই.... মুড়ি লাগবো...ও.ও.ও....... মুড়ি...ঈ.ঈ.ঈ......

বৃদ্ধ আলী আজ্জম। সারাদিন কারও ওপর নির্ভর না করেই শরীরটাকে টেনে নিয়ে যান সামনে।

কেউ নেই !
আছে। পোলা, মাইয়া, বৌ -ঝি আছে।
ছেলেরা দেখাশুনা করে না !
সারা শরীর থেকে ঘাম ঝড়ছিল বুড়োর। খাড়া নাক। তীক্ষ্ণ খাড়া নাকের ডগা থেকে ঘাম ঝরছিল টপ টপ করে। তীব্র উজ্জল দুটি কঠিন চোখে তাকায় বুড়ো - হাতের তালুতে ঘাম ঝাড়েন। নড়েচড়ে বসে বলেন -
ওগোরে লই ওরা আছে। হেগো খানা আমি খামু ক্যান । আমার তো এখনো গতর আছে।
কয় ছেলে আপনার ?

‘তিন ছেলে। দুই পোলা বদলা মুইয়া দেয়। বিয়া করাইছি। হেরা হেগোরে লই থাকে। ছোটটারে আইএ পর্যন্ত পড়াইছি। নোয়াখালী কলেজের তুন পরীক্ষা দিছিল। পাস কইত্তো পারেনো। এখন এই টুকটাক নারিকেলে - সুপারির ব্যবসা করে। হেটা আমার কাছে থাকে।

নোয়াখালী শহরের পাশেই রাজগঞ্জের তেতুঁইয়া গ্রামে বাড়ী আলী আজ্জমের। বাবা আইয়ুব আলী সৈয়ালের কাজ করতেন।‘৬২ সালে মারা গেছেন। বাবার রেখে যাওযা ভিটিতেই থাকেন আলী আজ্জম। একেবারে শৈশবে মাত্র নয় বছর বয়স থেকেই শুরু করেছের ব্যবসা। নানা রকমারি ব্যবসা। মাছের পোনা বিক্রি। ধান চালের ব্যবসা। তারপর শেষে ধরেছেন এই মুড়ির ব্যবসা ত্রিশ বছরেরও বেশি সময়ে ধরে এই ব্যবসা করছেন। পান- খাওয়া পাতলা ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কালচে দাঁত নড়েচড়ে ওঠে। অসাধারন এক দৃপ্ত স্বরে বলেন -
’আমি কোনদিন কারও অধীনে ছিলাম না। স্বাধীনভাবেই চইলা আইছি। পরনির্ভর আমি না'। অসম্ভব দৃঢ়তা ফুটে ওঠে তাঁর চোয়ালে। পাকা পাতলা দাঁড়ির ফাঁকে কঠিন চোয়ালের ওপর নীল মোটা রগের রেখা ফুটে ওঠে। আপনার বৌ কি আছে এখনো ?
‘হ’ আছে । এখন আর বেশী কাজ কইত্ত পারে না। বুড়ো অই গেছে ।’
কত বছর বয়সে বিয়ে করেছেন ?
আমার তখন ষোল বছর ছিল’ ।
একটু যেন আনমনা হয়ে ওঠেন। হয়তো ঠিক এই সময়ে সুদূর অতীতের জীবনের শুরুর কোন রোমাঞ্চকর সুখকর স্মৃতি আবছা ধরা পড়ছিল। সে মুহুর্তটি বেশিক্ষণ থাকল না তাঁর। মুড়ি কোত্থেকে কেনেন ?
‘রামগতি, চরবাটা, চরলক্ষীর চরের থুন।’
ধান কিনে ঘরে মুড়ি ভাঙ্গেন ?
‘না। বাড়ি বাড়ি যাই মুড়ি কিনি। ঘিগজ ধানের মুড়ি। এই ধানের মুড়ি বালা। খাইতে স্বাদ। মচমইচ্চা।’
মাইজদী শহর থেকে বিশ পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি নিজেই মুড়িগুলো দেখে শুনে কেনেন। মাইজদী বাজারে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছেন। একশ’দশ টাকা ভাড়া দেন মাসে। মুড়িগুলো বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে এনে এখানে রাখেন। তারপর সেখান থেকে বস্তায় ভরে দাড়িপাল্লা নিয়ে বের হন শহরে। মন হিসাবে কিনে আনেন। বিক্রি করেন কেজি মাপে। প্রতি কেজিতে আড়াই থেকে তিন টাকা লাভ হয়। শেষবার মন কিনলেন এগারশ’ পঞ্চাশ টাকায়। বিক্রি প্রতি কেজি করলেন পয়ঁত্রিশ টাকায়। প্রতিদিন কত কেজি বিক্রি করেন ?
‘পঁচিশ ত্রিশ কেজি।’
আপনার বৌ মুড়ি ভাজে না ! তাহলে তো আরো বেশী লাভ হতো। নিজে ভাজলে খরচ তো কম পড়তো।
পড়তো হয়তো। একটু নরম সুরে বললেন - ‘আগে ভাজতো এখন পারে না’।
একটা স্নেহার্ত সুর বেজে উঠে তাঁর কন্ঠে। শহরে ক’টি নির্দিষ্ট বাড়িতে তাঁর নিয়মিত গ্রাহক আছে। গৃহবঁধুরাই তাঁর কাছ থেকে বেশী মুড়ি কেনে।
লাভ এর চেয়ে বেশী করতে পারেন না ?
ক্ষেপা সুরেই বলে উঠলেন, ‘লাভ কইরলে তো কইত্তে পারি। ভেজাল দিলে তো লাভ হয়, কিন্তুক আল্লাহর কাছে ঠেকা থাকুম। আর হের্‌কুম কইত্তামওবা কিয়ের লাই। ইন্ডিয়ার এক কিসিম চাইল আছে। ভেজাইল্লা চাইল। দাম মেলা কম। হেগুন দি ভাইঙলে মেলা লাভ হয়। আঁর হেই লাভের দরকার নাই’।

মুড়ি বাঙালি সমাজে এক জনপ্রিয় খাদ্য। সে স্থান দখল করে নিচ্ছে নানা সুসজ্জিত মোড়কের বিস্কুট। নানান মুখরোচক প্রচারনায় আকৃষ্ট করেছে গ্রাহককে। লাভের পাহাড় গুনছে কেউ কেউ। বুড়ো আলী আজ্জম সেই লাভের পাহাড় দেখেন না। খাঁটি আর নির্ভেজাল মুড়ি গ্রাহকের হাতে তুলে দিতে পারলেই যেন তাঁর তৃপ্তি। বৃষ্টি বাদলের দিনে অথবা কোন রোদেলা দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে কারো দোর গোড়ায় এই মুড়ি পৌঁছে দিতে পারলেই যেন তাঁর স্বস্তি। মফস্বল শহরে ইঁটের সুরকি ওঠা খিঁচড়ি খেউড়ে গলির রাস্তায় হেঁটে যান বৃদ্ধ আলী আজ্জম। তখন হয়তো কোন বাড়ির কোন কুলবঁধূ আধো ঘোমটা উঁচিয়ে দরজার ডালা মেলে মুড়ির জন্য অপেক্ষা করে। দাওয়ায় এসে বুড়ো হাঁক দেন -

‘মুড়ি লাইগবোনি মা, মুড়ি। মচমচে মুড়ি।’


মুক্তকন্ঠ, লোকসংবাদ


--Foez 18:35, 19 January 2010 (UTC)