বান্দরের বান্দরামি
বান্দরের বান্দরামি
মাহমুদুল হক ফয়েজ
বান্দরে বান্দরামি করে না ; বান্দরামি করে ম্যাইনষে
সময়টা ছিল ঠিক দুপুর। লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল। চওড়া কাঁচা রাস্তার মাঝ বরাবর সোজা পুর্বদিকে। কাঁধে ঝোলা। ঠিক ঝোলা নয়, বাঁশের টুকরির মতো ঝুড়ি। টুকরির দু পাশ চিপে খাঁচার মতো করে মুখ বেঁধে লম্বা একটি বাঁশের লাঠিতে ঝুলিয়ে নিয়েছে সে ঝুড়ি। একটি ছাতাও আছে সাথে। বন্ধ করে লাঠির সাথে বাঁধা।
যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল লোকটা সে রাস্তাটি ছিল নোয়াখালীর পুরাতন শহরের অন্যতম প্রধান রাস্তা। এক সময় এটি ছিল চট্টগ্রাম ভবানীগঞ্জ সদর রাস্তা। এক সময় এ রাস্তাটিই ছিল নোয়াখালী হয়ে চট্টগ্রাম লক্ষ্মীপুরের সরাসরি যোগাযোগ। চল্লিশের দশকে সেই নোয়াখালী শহরটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে এ রাস্তাটির অস্তিত্বও হারিয়ে যায়। পরে নদী থেকে ভূখন্ড আবার জেগে উঠলেও সে ব্যস্ত নগরী আর ফিরে পাওয়া যায়নি। তখন যে যায়গায় রাস্তাটি ছিল ঠিক সে জায়গার উপরই আবার রাস্তা বানায় জেলা পরিষদ। এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যস্ত নগরী এখন চরাঞ্চল বলেই পরিচিত। সেই ব্যস্ত নগরীর হাট বাজার, অফিস, আদালত,দালান কোঠার চিহ্নটিও এখন আর নেই। বিশাল ঘোড়দৌড়ের মাঠ, চওড়া সদর, রাস্তা, কর্মঞ্চলতার শহরে মাঠের পরে মাঠ জুড়ে এখন শুধু সবুজ ধান ক্ষেত। বর্ষায় জলাভূমি। বর্ষা শেষে ধুলিময় বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মাঝে মাঝে সবুজ গাছে ঘেরা কৃষকের ছোট ছোট বাড়ি।
ধান কাটা হয়ে গেছে। ছোট বড় কৃষকের ঘরের গোলায় ধান তোলা হয়ে গেছে। সবার কাছে উপরি খরচ করার কিছু পয়সা এসে গেছে। ঠিক এ সময়টাই বেছে নিয়েছে লোকটা। এ অবস্থায়ই তার স্ঙে আমার দেখা। আমার কাঁধেও ক্যামেররার ঝোলা ব্যাগ। একই পথে দু দিকের দু পথিক। আমার একেবারে পাশ ঘেঁষে তার স্বভাব সুলভ হেঁটে যাওয়ার কয়কদম পরেই পিছনে ফিরে তাকাই। টুকরির ভিতর কি যেন নড়েচড়ে উঠল। আমি ঘুরে দাঁড়ালাম। কৌতুহলী হয়ে ডাক দিতেই লোকটা ঘুরে রাস্তার এক পাশে গিয়ে দাঁড়াল। যেন আমার ডাকার অপেক্ষাই করছিল। কাছে গিয়ে বললাম, আপনি কি বান্দরের খেলা দেখান? জী। খেলা দেখাই, গনাই।
কি রকম গনান?
ভাগ্য গনাই। প্রেম প্রীতি গনাই, ভালোবাসা গনাই। ব্যবসা বানিজ্য আয় উন্নতি গনাই। দেশ বিদেশে যাবার ভাগ্য গনাই। স্বামী স্ত্রীর মনোমালিন্য গনাই। অসুক বিসুক, ভালো মন্দ গনাই। তাবিজ তুমার করল কিনা গনাই। যুবতী মাইয়ার বিয়া বন্ধ গনাই।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেল লোকটা। আমি হাসলাম। এত কিছু’।
লোকটা সায় দিলো ‘হুঁ’
একটু দেখা যাবে?
হ যাইবে। বলেই লোকটা ঝুড়িটাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে রাস্তার পাশে গিয়ে বসল। আমিও বসলাম পাশে। টুকরির মুখ খুলতে খুলতেই লোকটা বলে উঠে, সাধু তোরে স্যারে দেখতে চায়’। মুখ খিচিয়ে কি যেন বলতে চাইল বানরটা। লাঠির মধ্যে জোরে এক থাবা বসাল। আকেটা ঝাঁপ দিতেই লোকটা শিকল চেপে ধরল। বসে পড়ল বানরটা। বসে ইতিউতি চাইল চারদিক। লোকটা আর আঙ্গুল উচিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল, সাধু স্যারেরে সালাম কর।
লোকটার ডান হাতের দু আঙ্গুলের দু রঙের দুটি আকিক পাথরের আংটি পরা। সাথে সাথে বানরটা থাবা মেরে তার একটা আঙ্গুল ধর মাথায় ঠেকাল।
বান্দরের নাম বুঝি সাধু?
“হ”
‘আপনার নাম?’
‘রাজা মিয়া।’ মুখে এক গাল কাঁচা-পাকা দাঁড়ি।
‘কোথায় থাকেন?
মাইজদী বাজার। বাজিগর পাড়া।
‘কত বছর ধরে এ খেলা দেখান’?
‘প্রায় তিরিশ বত্রিশ বছর’।
বাঁদরটা কত বছর আপনার কাছে’
তেইশ বছর’।
কি খাওয়ান?
কলা ফল মুল ভাত খায়।
‘খুব বুঝি যত্ন করেন?
যত্নতো করেতই হইব। বনের পশু আমার কাছে থাকে। আমি না খাইয়াও তারে খাওয়াই। বানরটার চঞ্চলতা বেড়েই চলে। রাজা মিয়াকে জিজ্ঞাসা করি, বনের পশু মানুষের ভাগ্য কিভাবে গুনতে পারে?
অনেকটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই রাজা মিয়া বলে-‘পারে পারে হেরাই তো পারে। মাইনষে ম্যাইনষেরে চিনে না। কারো চেহারা দেইখা আপনি চিনতে পারবেন না। তার মনের কথা আপনে কইতে পারবেন না। মুখে একটা অন্তরে আরেকটা। কিন্তুক ম্যাইনষের মুখ
দেইখ্যা অন্তরের কথা কইতে পারে বনের বান্দর। আমাদের কথা জামে উঠে। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে দু এক জন কৌতুহলী পথচারী থমকে দাঁড়ায় আমাদের পাশে। বানরের নাচানাচি উপভোগ করে তারা। ‘এ বানরটা ধরেছেন কোথেকে? ‘আমি ধারি নাই। আমার ওস্তাদে আমারে চিছে।
‘বান্দর ধরে কেমনে? আমি জানতে চাই।
রাজা মিয়া বলেন, ‘বনের বোবা জাতরে ঠগাইয়া ধরে। ক্যামনে জানেন? রাজা মিঞা বলতে থাকে। বার্মা দেশের আকিয়াব পাহাড়ে বান্দর গুলানরে ধরে। একটা কলসিরে মাটির মাইধ্যে পুঁইতা, মুখটা উপর তুইলা রাখে। তারপর কলসির মধ্যে মুড়ি দিয়া রাখে। বান্দর গুলা ক্ষিদার জ্বালায় আইসা কলসির মইধ্যে হাত দিয়া মুঠ করি মুড়ি লয়। হাতে মুঠ বড় ইয়া গেলে কলসির চিকন মুখ দিয়া বাইর হয় না। আটকাইয়া যায়। অবুঝ বান্দর মুড়িও ছাড়ে না। মুঠও খোলে না। তখন লোকে আইসা বান্দরগুলোরে ধইরা ফেলায়।
আমি খুব আগ্রহী হয়ে উঠি, বলি খুব মজার তো।
‘হ মজার। তয় কি জানেন। ওগো তো এটাই স্বভাব। বান্দরতো লাফালাফি করে। গাছের এডাইল থেইকা ও ডাইলে যায়। আমাদের কথা জমে ঊঠতে থাকে।
এ সময় বানরটা খুব অস্থির হয়ে উঠে। বার বার খামচি দিতে চাইছিল রাজা মিয়াকে কাঁধের উপর উঠতে চাইল কয়বার ঘাসের উপর থেকে একটা ছোট কাঠি তুলে মুখে নিয়েই থু মেরে ফেলে দিল বানরটা। আমি হেসে বললাম,
আপনার বান্দরতো খুব বান্দরামি শুরু করে দিয়েছে।
রাজামিঞা গম্ভীর হয়ে যায় দৃঢ় গলায় বলে উঠেন, বান্দরে বান্দরামি কইরবো ক্যান। বান্দরে তো বান্দরামি করে না বান্দারামি করে তো মাইনষে। আমি থ হয়ে যাই। তাইতো !
রাজা মিঞা বলতে থাকে ‘দেখেন না স্যার বনের পশুরে আল্লা যে স্বভাব দিছে হেরা হেই স্বভাব লইয়া আছে। যার যেই স্বভাব হেই ভাবেই হে কাম করে। কিন্তু মানুষের দিকে চাইয়া দেখেন। হেরা কি কাম কইরতাছে। মাইনষের কাম দেইখ্যা মানুষ চিনা যায় না। মানুষের কাম ম্যাইনষে করেনা। হগলটি করে আকাম। সব বান্দরামি। । রাজা মিয়া বিড় বিড় করে। মানুষ মানুষেরে খাবলাইয়া খায়, খামচাইয়া খায় চিবাইয়া খায়।
আমি চুপ হয়ে যাই। একবার বানরের দিকে একবার বানর ওয়ালা রাজা মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি। দুপুরের রৌদ্রজ্জ্বল রাস্তায় আমরা দুজন । আর এক অবুজ বানর।
দক্ষিনের বঙ্গপসাগর থেকে এক ঝাপটা নোনা বাতাস বয়ে যায়। আমি আর কিছু বলতে পারি না। আমার হাতের ক্যামেরাটা ক্লিক ক্লিক শব্দ করে উঠে। নীরবে ক্যামেরার ব্যাগ গুছিয়ে গন্তব্যে ফিরে যেতে থাকি। কানে অনবরত কথা গুলো অনুরনিত হতে থাকে
"বান্দরে তো বান্দরামি করে না বান্দারামি করে তো মাইনষে"।