বয়ঃসন্ধিকাল
গবষেণা
'বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের সেবাযত্ন
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
বয়ঃসন্ধিকালে কিশোর কিশোরীদের সেবাযত্ন
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
বয়ঃসন্ধি কালে কিশোর কিশোরীদেরকে অনেকেই বুঝতে পারেনা। এ সময় তদের শুরু হয় নানান শারীরিক মানসিক পরিবর্তন। আচার আচরনে এরা কখনো হয় একরোখা আবার কখনো নিজেদেরকে আড়াল করে লুকিয়ে রাখে। পাড়াপড়শী সমাজ এমনকি বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও এদের আচরনকে আড় চোখে দেখে থাকে। এ সময়টিকে কিভাবে উত্তরণ করবে, সে উপদেশ গুলোও তারা কারো কাছে পায় না। পাঠ্যপুস্তকেও এ বিষয়ে কোনো উল্লেখ নেই। অনেক অভিভাবক এ বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে আলাপচারিতা করতে কুন্ঠা বোধ করেন। তাঁরা মনে করেন এ সময়টি স্বাভাবিক ভাবেই কিশোর কিশোরীরা পার করে দেবে। এ নিয়ে তাদের সাথে কথা বলার প্রয়োজন নেই। গণমাধ্যম বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ম্যাসলাইন মিডিয়া সেন্টার(এমএমসি) আয়োজিত ও আর্টিকেল-১৯ এর সহায়তায় ‘বয়ঃসন্ধিকালীন স্বাস্থ্যসেবা ও পরিচর্যা’ বিষয়ক এক গবেষণায় এ তথ্যগুলো পাওয়া গেছে। এর কার্যক্রম হিসাবে নোয়াখালীর তিনটি স্কুলে অংশগ্রহণমূলক কর্মগবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। এর জন্য নোয়াখালী শহর, গ্রাম ও শহরতলীর তিনটি স্কুলকে বাছাই করা হয়েছে। প্রতিটি স্কুলে রয়েছে সহ-শিক্ষা বা কো-এডুকেশন। প্রতিটি স্কুল থেকে ১২জন করে শিক্ষার্থী বাছাই করা হয়েছে। দুটি স্কুল থেকে নেয়া হয়েছে ১২ জন করে মোট ২৪জন কিশোরী এবং একটি স্কুল থেকে নেয়া হয়েছে ১২ জন কিশোর। প্রতিটি স্কুলে এই ১২ জনকে নিয়ে গ্রুপ করা হয়েছে। আবার স্কুলের এই শিক্ষার্থীদের অবিভাবকদের নিয়ে ১২ জন করে এক একটি গ্রুপ করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনটি স্কুলের ১২ জন করে তিনটি গ্রুপ এবং ঐ শিক্ষার্থীদের ১২ জন অভিবাবক নিয়ে তিনটি গ্রুপ। শিক্ষার্থী ও অভিবাবক নিয়ে আলাদা করে মোট ৬টি গ্রুপ করা হয়েছে। এদের প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা করে কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে ৩টি করে মোট ১৮টি কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিলো। কর্মশালার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিলো অংশগ্রহনমূলক কর্মগবেষণা পদ্ধতি। যারা এই কর্মগবেষণায় অংশগ্রহন করে তারাই মূলতঃ এর গবেষক। যে সব স্কুলে গবেষণার কর্মশালা করা হয়েছিলো সে গুলো হলো,নোয়াখালী পৌরসভার এম,এ,সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়, নোয়াখালী সদর উপজেলার কাদির হানিফ ইউনিয়নের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় এবং বেগমগঞ্জ উপজেলার শরিফ পুর ইউনিয়নের হাসান হাট উচ্চ বিদ্যালয়। এবছর আগষ্টের ১৫ তারিখ থেকে প্রায় এক মাস এ গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
বয়ঃসন্ধি কাল মানুষেরে জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সময়। এবয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে প্রবেশ করে এক অজানা জগতে। চরম কৌতুহল নিয়ে সে দেখে তার চারদিকের পৃথিবীকে। এ সময় তার শারিরীক ও মানসিক অভুতপূর্ব পরিবর্তন ঘটে। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক প্রোপটে এ সময়টা থাকে সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত। কিশোর কিশোরীরা অজ্ঞতার কারনে সঠিক পরিচর্যা পায়না। শহর ও গ্রামের এলাকা ভেদে এদের চাল চলনের ধরণ হয় আলাদা। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে অনেক ক্ষেত্রেই এরা দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে। অভিভাবকরাও এ বয়সকে সহজ চোখে দেখতে চান না। অনেক ক্ষেত্রেই তাঁরা থাকেন একেবারে উদাসিন। আবার মেধা বিকাশেও চরম বাধার সম্মুখে পড়তে হয় এদের। তখন নষ্ট হয় উজ্জল সম্ভাবনা। জাতি হয় ক্ষতিগ্রস্ত।
এ পরিপ্রেক্ষিতে নোয়াখালী জেলার শহর শহরতলী ও গ্রাম পর্যায়ের তিনটি স্তরের এই কিশোর কিশোরীদের বিভিন্ন সমস্যা ও এর সমাধানের পথ অনুসন্ধান এবং তাদের অবিভাবকদের মানসিকতা পর্যালোচনা করাই ছিলো এই গবেষণার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
মানুষের জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পরিবর্তন আসে। যেমন - ছোটবেলা একরকম, কিশোর বয়সে একরকম, আবার বড় হয়ে যাওয়ার পর অন্যরকম। তবে, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন আসে কৈশোরে। শিশুকাল আর যৌবনের মাঝামাঝি সময়কে বয়ঃসন্ধি কাল বা কৈশোরকাল বলে। এরা কিশোর কিশোরী। এ বয়সে এরা আরো বেশি বুঝতে শেখে। অনুভব করতে শেখে, বাইরের পৃথিবী এবং জীবন সম্পর্কে আরো বেশি জানতে চায়।
১০ বছর থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত সময়কে বলে বয়ঃসন্ধি কাল। কেউ বলে উঠতি বয়স। শরীরের গঠন আর পুষ্টির উপর ভিত্তি করে সাধারণত ১০-১২ বছর বয়সে এদের শারীরিক পরিবর্তন শুরু হয়।
এ সময় কিশোর-কিশোরীরা দ্রুত বেড়ে উঠে। একেক জনের শরীর যেহেতু একক রকম। তাই কেউ বড় হয় তাড়াতাড়ি আর কেউ বা একটু দেরীতে। দেহের চাহিদা অনুযায়ী এ সময়ে পুষ্টিকর ও সুষম খাবার গ্রহণ করলে শরীরের বৃদ্ধি পুরোপুরি হয়।
এ বয়সে ছেলেদের উচ্চতা বাড়ে, কাঁধ চওড়া হয়, মাংসপেশী শক্ত হতে থাকে। মুখে দাড়ি গোঁফ গজাতে শুরু করে ও কন্ঠস্বরের পরিবর্তন হয়।
মেয়েদের শরীর ও এ বয়সে বাড়তে থাকে। মেয়েলি পরিবর্তনগুলো শুরু হয় এবং চেহারায় লাবন্য আসে। এই পরিবর্তনগুলি হচ্ছে একটি ছেলে বা মেয়ের বড় হওয়ার লণ। বয়ঃসন্ধিকাল মানুষের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তন ঘটার ফলে মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়। এ সময় তাদের মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দেয়। মন চঞ্চল হয়ে উঠে। মনের ভিতর দ্বিধা দ্বন্দ্ব আর আবেগ অস্থিরতা বেশি কাজ করে। এসময় ছেলেমেয়েরা নিজেদের বড় ভাবতে শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে এ বয়সে তারা শরীর, চেহারা, পোশাক ও আচার-আচরণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। কখনো মন বিষন্ন হয়ে উঠে আবার কখনো মন খুশিতে ভরে যায়। এসময় অনেকে একা থাকতে চায়। কারো সাথে মিশতে চায় না।
তাদের মনে স্বাধীন ও স্বনির্ভর হওয়ার ভাবনা আসে। বয়ঃসন্ধিকালে ছেলে ও মেয়েদের সাথে বাবা-মা ও পরিবারের আচরনের তারতম্য বেশি দেখা যায়।
আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছেলে এবং মেয়েদের সমান চোখে দেখা হয় না এবং তাদের সাথে একই রকম ব্যবহার করা হয় না। জন্মের পর থেকে মেয়েরা বিভিন্ন ভাবে বৈষম্যের শিকার হয়।
এসময় মেয়েরা নিরাপত্তার অভাবে ভোগে। কেউ কেউ এ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। অনেক সময় যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেক ছেলে বা মেয়ে মানসিকভাবে কষ্ট পায়। আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে এবং স্বাভাবিক হতে পারে না।
তাই এসময় নিজের চিন্তা এবং সমস্যাগুলি যদি পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে আলাপ করে নেয়া যায় এবং সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী করা যায়। তাহলে বিভিন্ন সমস্যা সহজে সমাধান করা সম্ভব হয়।
এ বিষয়ে গবেষণায় কিশোর কিশেরী ও অভিবাবকদের কাছ থেকে নানান চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়। গবেষকদের কাছে এক কিশোর জানায় “আমাদেরকে আমাদের বাবা মায়েরা মোটেও বুঝতে চায়না। কিছু না বুঝেই তাঁরা অনেক সময় মারধর করেন। তখন মনটা খুব ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সমাজ ও আমাদেরকে বাঁকা চোখে দেখে। আমরা চাই আদর স্নেহ মায়া মমতা। কিন্তু আমরা কখনো তা পাইনা। ছোট ছোট কাজে আমাদেরকে কেউ প্রশংসা করেনা”। এসময় নানান শারিরীক পরিবর্তনের কথা লজ্জায় কারো সাথে তারা আলোচনা করেনা। মাঝে মাঝে একান্ত বন্ধুদের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। গোপন অঙ্গে কোনো অসুখ হলে লজ্জায় তারা বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চায়না। মেয়েরা আরো জানায়, মায়েদর কাছে তারা আশ্রয় পশ্রয় বেশী পায়, আবার বাবাদের তুলনায় তারাই বেশী মার ধর করেন। ছেলেরা জানায়, বার তের বছর বয়সে সকলেরই স্বপ্নদোষ হতে শুরু করেছে। এ সময় তারা অনেকেই নিয়মিত হস্তমৈথুনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই সমকামিতার আভিজ্ঞতা রয়েছে।
কিশোরীরা জানায়, ১০-১৩ বছর বয়সে তাদের ঋতুস্রাব হয়েছে। অনেকেরই এ বিষয় আগে কোনো ধারণা ছিলোনা। তাই প্রথম তারা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। মেয়েরা জানায়, অনেক জটিল রোগে তারা ভুগলেও লজ্জায় ডাক্তারের কাছে যায়না। আনেক সময় বেদেদের কাছ থেকে টোটকা ঔষধ নিয়ে থাকে। তারা জানায়, ‘স্কুলে ফাষ্টএইড বক্স’ এবং ঋতুকালীন সময়ের জন্য বিশেষ ব্যাবস্থা থাকা উচিৎ।
অনেক অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা কেউ কেউ খেয়াল রাখতে চাইলেও অনেক সময় হয়ে উঠেনা। বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয় নিয়ে তাঁরা কেউ তেমন ভাবনা চিন্তা করেননা। মায়েদের সঙ্গেই সন্তানদের সম্পর্ক ভালো।
কিশোর কিশেরীরা জানায়, মানসিক ভাবে তারা বিপরিত লিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে। পড়া লেখায় এ সময় অনেকেরই মনোযোগ নেই। তারা জানায়, স্কুলের পাঠ্য সূচীতে বয়ঃসন্ধিকালীন বিষয়টি থাকা খুবই প্রয়োজন।
গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন
সাংবাদিক ও গবেষক, মাহ্মুদুল হক ফয়েজ