নোয়াখালীর কথিত বনদস্যু নিধন
নোয়াখালীর কথিত বনদস্যু নিধন : ধামাচাপা পড়ে গেলো কি ?
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালী নানান ভাবে দেশে বিদেশে পরিচিত। সন্ত্রাসমুক্ত জেলা হিসাবেও এর পরিচিতি রয়েছে। তবুও শান্ত স্নিগ্ধ এই উপকূল কখনো কখনো রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠে। এই সবুজ প্রান্তরে মানবাধিকার বিষয়ক কোনো ঘটনা ঘটলে একজন মানুষ হিসাবে, নাগরিক হিসাবে আমরা বিচলিত না হয়ে পারিনা। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে সে সব ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য। দেশের আনাচে কানাচে মাঝে মাঝে নানান অবাঞ্ছিত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে যায়। আমরা শুধু আমাদের চোখের সন্মুখের কিছু বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ডের কথাই বারবার ঘুরে ফিরে বলছি। এছাড়াও বিগত সময়ে আরো কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। সেগুলো আমাদের স্মৃতি থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে নোয়াখালীর চরে ভূমিদস্যুতার অভিযোগে ৩৯ জন মানুষকে নির্মম ভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। সে বছর ডিসেম্বরের ৬ তারিখ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত এ হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়। তার পরের বছর ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের স্থানীয় সংসদ সদস্যের নেতৃত্বে সর্বদলীয় ভাবে মহা-উৎসবের সাথে এ হত্যাকান্ডের বর্ষপূর্তি উৎযাপন করা হয়। এখনঅব্দি সে উৎসব মহা আনন্দের সাথে প্রতিবছর পালন করা হচ্ছে। অনৈতিক এত বড় হত্যাযজ্ঞকে উৎসব হিসাবে পালন করার নজির কেউ কখনো কোথাও দেখেনি। এ অনৈতিক নৃসংশ হত্যাকান্ডের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছিলো উচ্চমহল প্রভাবশালী জোতদার ভূমিগ্রাসীদের সীমাহীন লালসার মোহ থেকে। এর প্রধান সূত্র জেলার বিপুল পরিমানের খাসজমি।বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা নোয়াখালীর দক্ষিনে সমুদ্র থেকে জেগে উঠেছে বিশাল চর। এই নতুন চর নিয়ে ভূমিহীনদের সাথে প্রশাসন, স্থানীয় জোতদার, ভূমিগ্রাসী প্রভাবশালী মহলের সাথে সংঘাত নিত্যদিনের ঘটনায় পরিনত হয়েছে। এই ভূমিকে কেন্দ্র করে সেখানে গজিয়ে উঠেছে ভূমিদস্যুদের চক্র। অভিযোগ রয়েছে প্রভাবশালী মহলই এই ভূমিদস্যুদের লালন পালন করে আসছে। তারাই আবার জনতাকে উসকে দিয়ে নির্বিচারে এদেরকে পিটিয়ে মেরেছে। সে সময়ের নোয়াখালী জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, সরকারী দলের স্থানীয় সংসদ সদস্য জোতদার এবং যারা পিটিয়ে মেরেছে তারা বলেছিলেন, নিহতরা ছিলো সন্ত্রাসী, বনদস্যু, নরহত্যাকারী, ডাকাত লুটেরা। প্রশাসন বলেছিলো, বছরের পর বছর ধরে নোয়াখালীর চরের মানুষ ত্যক্ত বিরক্ত অতীষ্ট হয়ে এ খুনের যজ্ঞ ঘটিয়েছে। শুধু খুনই নয়, অর্ধমৃতঅনেকের চোখে চূন ঢেলে, সরু লোহার শলা, কাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অনেকের ঘর বাড়ি। প্রত্যদর্শীরা বলছে, এদের অনেকেই ছিলো ভূমিহীন কৃষক। এ ঘটনায় সমগ্র দেশের মানুষ উদ্বিগ্ন ও শিহরিত হয়ে উঠেছিলো। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, এ ভাবে পিটিয়ে খুন কেন! ঘটনাগুলো ঘটেছিলো দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সামনে। প্রশ্ন উঠেছে কারা সাধারণ জনতাকে নিজের হাতে আইন তুলে এই উন্মত্ততার জন্য উস্কে দিয়েছিলো। কারা এর ইন্ধনদাতা? আঁটঘাট বেঁধে হঠাৎ করে এঅভিযানের অন্য লক্ষও কি কিছু ছিলো? অনেকেই মনে করেন, ভূমিহীনদের অধিকারের খাসজমি দখল ও চিংড়ি ঘের স্থাপন করতে খাস জমি দখল করার জন্য ক্ষমতাসীনদের এটি ছিলো একটি
পরবর্তিতে বিগত জোট সরকার নোয়াখালীর উপকূলে ১১ হাযার ৮০০শ’ একর অত্যন্ত উর্বর ভূমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী চিংড়ি মহাল ঘোষনা করে। কিন্তু সে যায়গায় দীর্ঘদিন থেকে ভূমিহীনরা বসতি স্থাপন করে আছে। ভূমিহীনরা মনে করে খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার অধিকার একমাত্র ভূমিহীনদেরই রয়েছে। সে সময় ভূমিহীনদের ঊচ্ছেদ না করার জন্য হাইকোর্ট একটি নির্দেশনামা জারি করেছিলো। ঠিক সেই মূহূর্তে ঐ এলাকাতেই বনদস্যু নিধনের অভিযান শুরু হওয়ায় অনেকের মনেই নানান প্রশ্ন ও সন্দেহ দেখা দেয়। অবিশ্বাস্য এই লোমহর্ষক হত্যা যদি উদাহরণ হয়ে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশের আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তা কল্পনায় অসলেও শরীর শিহরিত হয়ে উঠে। তুচ্ছ কারনেও মানুষ নিজেদের হাতে আইন তুলে নিবে। দেশ নেমে পড়বে এক অরাজক পরিস্থিতিতে। তাই কোনো কারনেই এ হত্যাযজ্ঞকে উৎসাহ বা সমর্থন করা যায়না। ইতিমধ্যে আমরা তার কিছু আলামতও দেখতে পেয়েছি। বাংলাভাই এবং তার জাগ্রত মুসলিম জনতার উত্থান আমরা প্রত্য্য করছি। নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে রাজপথে ছিঁচকে চোর ছিনতাইকারি পকেটমারকে পিটিয়ে মারা, জনসভায় প্রকশ্যে পিটিয়ে হত্যা ইত্যাদিতো এ জাতি চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করেছে।
সত্তর দশকে নোয়াখালীর দেিন মেঘনার মোহনা ও সন্দ্বীপ চ্যানেলে জেগে উঠে বয়ার চর, নাঙ্গলীয়া, চরলক্ষী, চর উড়িয়া সহ বিশাল চরাঞ্চল। স্বাভাবিক কারনে ভূমিহীনরা সে খাস জমিতে বসতি স্থাপন করতে চায়। বনবিভাগ চর জাগার পর থেকে সৃজন করে নিবিড় বনাঞ্চল। এ সময় থেকে ভূমিহীনদের সাথে বন বিভাগের সংঘাত শুরু হয়। এক পর্যায়ে ভূমিহীনরা সংঘবদ্ধ হয়ে বন উজাড় করে বসতি স্থাপন করতে থাকে। বয়ার চর থেকে উচ্ছেদ হয়ে যায় বন কর্মীরা। বন বিভাগ সে সময় অভিযোগ করেছিলো, প্রশাসন তাদেরকে কোনো সহযোগীতা করেনি। এ ছাড়া সীমানা নির্ধারনের জটিলতা দেখা দেয়ায় সে এলাকায় প্রশাসন ছিলো নিষ্কৃয়। সে থেকে ধীরে ধীরে সমগ্র চরাঞ্চল মূলত: পাঁচ বনদস্যুর হাতে জিম্মি হয়ে যায়। এরা হোলো নব্যাচোরা, বশার মাঝি, সোলেমান কমান্ডার, সফি বাতাইন্যা ও জাহাঙ্গীর কমান্ডার। নানান মহলের আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়ে এরা এক একজন দুর্ধর্ষ দস্যু হয়ে উঠে। দীর্ঘ দিন ধরে নারী নির্যাতন সহ এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করলেও অভিযোগ রয়েছে সে সময় এদের ধরার জন্য প্রশাসন থেকে কার্যকর কোনো পদপে গ্রহন করা হয়নি। রাজনৈতিক দল গুলোর সাথে এদের ছিলো দহরম মহরম।
এখন স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, বনদস্যু নিধনের নামে মানুষ খুন করার অধিকার জনতাকে কে দিলো? কোন মহলের ইঙ্গিতে জনতা খুনের নেশায় মেতে উঠেছিলো? সবাই চায় গত কয়বছর ধরে চরাঞ্চলে যে দুর্ধর্ষ বাহিনী গুলো গজিয়ে উঠেছে ওদেরকে ধরে বিচার করা হোক। এরা মৃত্যুদন্ডযোগ্য অপরাধি। কিন্তু এই অপরাধের শাস্তি দেবে কে। এর জন্য আইন আদালত আছে। আইনের বিধান আছে। আইনের কোনো ফাঁকফোঁকর থাকলে তা সংশোধন করার আইন সভা জাতীয় সংসদ আছে। সংসদ সদস্যরা বসে আইন তৈরী করবেন। দেশের কাঠামো ঠিক করবেন। পরবর্তিতে আমরা দেখেছি তাদের লুটপাটের ইতিহাস। এই লুটপাট কিংবা গম ভাগাভাগির জন্য তাদেরকে জনগন সংসদ ভবনে পাঠায় নাই। ইতিমধ্যে সচেতন মহল এই হত্যাকন্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। গণহারে এ নরহত্যা সীমাহীন মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন তাহলে এই মানুষগুলো কি পরিস্থিতির শিকার হোলো?
দেশের সাংবিধানিক আইনে রাষ্ট্রের দায়িত্ব প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা। যতবড় নৃশংস খুনি অপরাধি হোক, মানুষ হিসাবে, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে, রাষ্ট্রের কাছে তার বিচার চাওয়ার ও পাওয়ার অধিকার রয়েছে। একজন খুনি দন্ডযোগ্য আসামীকে বিনা বিচারে খুন করা দন্ডযোগ্য আর একটি খুনেরই নামান্তর। এর সাথে প্রত্য ও পরভাবে যারা জড়িত আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান অপরাধি। ‘ইন্টারন্যাশনাল কাভিনান্ট অন সিভিল এন্ড পলিটিক্যাল রাইটস্’(ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঈড়াবহধহঃ ড়হ ঈরারষ ধহফ চড়ষরঃরপধষ জরমযঃং ) এর আর্টিকেল-৬ এ উল্লেখ আছে যে, প্রত্যেকের বাঁচার অধিকার আছে এবং সেই অধিকার আইনের দ্বারা সংরক্ষিত। অধিকিন্তু কেউ তার বেঁচে থাকার অধিকার থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত হবেন না(সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনা, ১৯৪৮-এর আর্টিকেল-৩)। এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের ১৯৮৯/৬৫ রেজুলেশন অনুসারে ‘বেআইনি ও অন্যায় হত্যা এবং আকষ্মিক হত্যার কার্যকরি অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে সরকারের দায় দায়িত্ব সুনিশ্চিত হয়’। এ বিষয়ে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষনার অর্টিকেল-৫ এ ব্যাক্তির মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোনো মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অমর্যাদাকর ব্যবহার বা নির্যাতন করা যাবেনা’। উক্ত চুক্তির ধারা-২ এর ৩-(ক) উপধারায় বলা হয়েছে ‘যদি কোনো চুক্তিতে বর্নিত অধিকার এবং স্বাধিনতা সমূহ লঙ্ঘিত হয়, তবে উহার প্রয়োজনীয় প্রতিকারের ব্যবস্থা করতে হবে, যদিও উক্ত লঙ্ঘন সরকারী কাজে নিয়োজিত ব্যক্তির দারা সংগঠিত হয়’। বাংলাদেশের সকল নাগরিকের অবশ্যই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কেউ চলমান আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
নোয়াখালীর চরাঞ্চলে যে গণহত্যার উৎসব হয়ে গেলো তা সুস্পষ্ট চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। কিন্তু আজও তার কোনো সুষ্ঠ তদন্ত হয়নি। সে হত্যাকান্ডেরও কোনো সুরাহা হয়নি। রাষ্ট্রিয় ভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারি অপরাধিদের বিচারের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। দেশের জনগণের এ ঘটনার সঠিক তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। সে এলাকায় ভূমিদস্যু নামে খ্যাত বশর মাঝি এখনো সক্রিয় রয়েছে। হত্যাকান্ডের সুষ্ঠ তদন্ত ও প্রকৃত দোষীদের বিচারের ব্যবস্থা করা, চরাঞ্চলের সন্ত্রাস দমন এখন সরকারের একটি নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে বর্তায়। যে বিপুল সংখ্যক খাসজমি প্রভাবশালী বিভিন্ন মহল জবর দখল করে আছে তা অতি দ্রুত উদ্ধার করে প্রকৃত ভুমিহীনদের মাঝে বিতরনের ব্যবস্থা করতে হবে। সচেতন মহল মনে করে, প্রকৃতির অপার কৃপায় নোয়াখালীর দক্ষিনাংশে যে বিপুল ভূসম্পদ দিন দিন জেগে উঠছে তার সঠিক ব্যবহার করতে পারলে নি:সন্দেহে দেশের অর্থনীতিতে সুফলতা বয়ে আনবে।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
Foez 12:30, 31 December 2009 (UTC)