তাল
│'তাল'
তাল
মাহমুদুল হক ফয়েজ
উদ্ভিদের নাম : তাল TAL
স্থানীয় নাম :তাল
ভেষজ নাম : Borassus flabellifer Linn,
ফ্যামিলিঃ- Palmeae.
ব্যবহার্য অংশ : সমগ্র গাছ, ফল ও পাতা, তালরস, তালের শাঁস ও তালের আঁঠির শাঁস, পুস্পদন্ড।
রোপনের সময় :বর্ষা কাল
উত্তোলনের সময় : মাদী গাছেই তাল হয়, তালের কাঁদি ২/২ফুট পর্যন- লম্বা হয়ে থাকে। সেই কাঁদিতে ২০/২৫টি পর্যন্ত তাল হতে দেখা যায়, তালের মোচ বেরোয় বসন্ত কালে, আর সেগুলি পাকে বর্ষাকালে, শ্রাবণ ভাদ্র মাসে তাল পাকে
আবাদী/অনাবাদী/বনজ: আবাদী বৃক্ষ
চাষের ধরণ : আঁটি রোপন করে চাষ করা হয়
উদ্ভিদের ধরণ: বড় গাছ , এর শাখা-প্রশাখা হয় না, ৬০/৭০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতে দেখা যায়। পরিচিতি: বড় নদী বা সমুদ্র উপকুলবর্তী এলাকায় এর বাড়বৃদ্ধি বেশী, যেখানে কোন কিছু চাষ হয় না সেখানেও তালগাছ হয়, সাধারনতঃ মাঠের ধারে একে লাগানো হয়। এর রস থেকে তাড়ি হয়, গাছের পাতা থেকে পাখা হয়, এর কচি ফল থেকে শাঁস বের করে বিক্রি হয়ে থাকে।
লোকজ ব্যবহারঃ- পুরানো তালগাছ যার বয়স অন্ততঃ ৪০/৪৫ বৎসর, এইসব গাছ চেরাই করে দেশগাঁয়ে বাড়ীঘর তৈরী করতে খুঁটি ও কড়িকাঠ হিসেবে তালের গুড়ি ব্যবহার করা হয়, তাছাড়া টিনের, টালির বা খড়ের ঘর বাঁধার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আর দেশগাঁয়ে বিশেষতঃ খাল-বিল যেখানে বেশী, সেখানে গাছের গোড়ার কিটা ১২/১৪ ফুট নিয়ে মাঝখানের অসার অংশকে ছেটে বাদ দেওয়া হয় এইটাই ডোঙ্গা নামে পরিচিত, ওর দ্বারা খাল-বিল পারাপারের এবং জল সেচার (সিঞ্চনের) কাজ হয়।
প্রাচীণ ব্যবহারঃ-এর পাতাগুলি চামড়ার মত শক্ত। এদেশে যখন কাগজ তৈরী হত না, তখন হাতের লেখা শেখার জন্য পাঠশালায় এই পাতার ব্যবহার প্রচলন ছিল।
ঔষধি গুনাগুন : তাল রস তিনটি আশয়ে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। আমাশয় (Stomach),অগ্নাশয় (Duodenum) ও পচ্যমানাশয়ে (Intestine, তবে রোগের ক্ষেত্রে টাটকা তালরসই বেশী প্রয়োগ করা হয়।
তালরসঃ- শীতল, বলকারক, শ্রমহর, উত্তেজক ও মূত্রকর। প্রত্যহ সকালে টাট্কা রস খেলে মৃদু বিরেচনেরকাজ করে। শোথ রোগীর পক্ষে উপকারী। তালরসকে সামান্য Fermented করিয়ে মধুমেহ রোগীকে খেতে দেওয়া হয়। Fermentation তালরস, যা চলতিকথায় তাড়ি, তা গণোরিয়া রোগে মূত্রকর হেতু পানীয়।
তালের শাঁস ও তালের আঁঠির শাঁসঃ- মূত্রকর এবং শরীরের পুষ্টিকারক। বিবিধ চর্মরোগে পাকা তালের শাঁসের প্রলেপ দেওয়া হয়। তালের শাঁস ও চালের গুঁড়ো মিশিয়ে অল্প গরম করে পুলটিস্ তৈরী করা হয়, যাকে আধুনিক চিকিৎসকগণ বলেন, টডি পুলটিস্, এটা কার্বাঙ্কল এবং বিবিধ দূষিত ক্ষতে ও পচা ঘায়ে প্রলেপ দেওয়া যায়।
পুস্পদন্ডঃ- অম্বল গলাবুক জ্বালা করলে সেক্ষেত্রে এটিকে ভস্ম করে ব্যবহার করলে বিশেষ উপকার পাওয়া যায়।
১। অনিদ্রায়ঃ- কোন সময়েই ভাল ঘুম হয় না, তার ওপর মাঝে মাঝে বুক ধড় ফড়ও করে, সেক্ষেত্রে কচি তালপাতার ডাঁটা ১০/১২ ইঞ্চি লম্বা করে কেটে, মাঝখানটাকে একটু থেতো করে, আগুনে সেকে, ডাঁটার দুই মুখ দুই হাতে ধরে মোচড় দিয়ে রস বের করে নিতে হবে। সেই রস দুই বা তিন চা-চামচ একটু দুধ মিশিয়ে খেতে দিতে হবে। এর দ্বারা ঐ অসুবিধেটা চলে যাবে।
২। বকবকানিতেঃ- কমা, ফুল্স্টপ্ নেই সর্বদা বকেই চলেছে, এও এক প্রকারের বায়ুর বিকার, এক্ষেত্রে টাটকা তালরস দুবেলা এক কাপ বা দেড় কাপ করে খাওয়ালে ঐ পায়রার মত বক্ বকানি কমে যাবে। যদি এই তালরস একান্তই যোগাড় করতে না পারা যায়, তাহলে জটা তালগাছের টাটকা রস খেলেও কিছুটা কাজ হবে, এই রস পরিমানে অর্ধেক হতে হবে। তবে এই রস একটু ঘোলা অথবা বাসি হলেই তাড়ি হয়ে যাবে, এক্ষেত্রে সে ধরনের রস খাওয়া চলবে না।
৩। গণোরিয়াঃ- যদিও এটাকে বলা হয়েছে ঔপসর্গিক মেহ, এটা ভিন্ন অন্য কারনেও পুঁজ মেহ হয়, একে গ্রাম্য লোকে “পুঁজ ধাতু” বলে। এই ক্ষেত্রে তাড়ি যখন ফেনাযুক্ত থাকে, সেই সময় খাওযাতে হয়, একে বলা হয় কাঁচা তাড়ি আর এর পরিমান ৭/৮ চা-চামচ বেশী নয়।
৪। শ্বেত প্রদরেঃ- নারী জাতির এটি একটি ক্ষয়ধর্মী রোগ, সাধারনতঃ তাঁরা একে উপেক্ষা করেই চলেন, অবশ্য রজোঃবিকাশের পরেই অনেকের এটা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে যদি তাঁরা তালের টাটকা রস অন্ততঃ আধ কাপ করে প্রত্যহ সকালে ও বৈকালে দুবার খেতে পারেন, তাহলে এর উপশম হবে। যাঁদের সর্দি-কাসির ধাত, তাঁদের ৩/৪ চা-চামচের বেশী যেন না হয়।
৫। রক্ত প্রদরেঃ- এটাতে মাসিক ঋতুর সময়ের বা পরিমানের ঠিক থাকে না। কোন মাসে হলো না, আবার পরের মাসে বেশী হলো এই যে, অনিয়মিত রজঃস্রাব একে আয়ুর্বেদিক ভাষায় বলা হয় রক্তপ্রদর, এক্ষেত্রেও এই রস কার্যকর। পূর্ব নিয়মে খেতে হবে।
৬। অল্পশ্রমে ক্লান্তিতেঃ- এর সঙ্গে মাথাটা যেন ভার হয়ে যায়, এটা আসে মস্তিস্কের দুর্বলতায়। এক্ষেত্রে ৩/৪বৎসর বয়সের তালের চারাগাছের মাথি আন্দাজ ৭/৮গ্রাম বেটে এক কাপ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে, ন্যাকড়ায় ছেকে ঐ দুধ মিশানো রসটা প্রত্যহ সকালের দিকে খেতে হবে। এর দ্বারা অল্পশ্রমের ক্লান্তিটা আর অনুভব হবে না। তবে প্রথম ২/৩দিন ৫/৬গ্রাম করে নিয়ে শিলে পিষে, দুধে গুলে ছেকে ঐ দুধটা খেতে হবে।
৭। অম্ল-অজীর্ণ ও পেটের ব্যথায়ঃ- এটা সাধারনতঃ অম্লপিত্ত রোগেই হয়, যাকে চলতি কথায় ‘অম্বলের রোগ’ বলে। এক্ষেত্রে কাঁচা তালজটা টুকরো করে কেটে, শুকিয়ে, হাঁড়িতে পুরে, সরা দিয়ে ঢেকে মুখ বন্ধ করে পোড়াতে হবে, একে বলে অন্তর্ধূমে পোড়ানো। এইগুলি পুড়ে রংটা হবে পাংশুটে অর্থাৎ খুব সাদাও নয় আবার কালোও নয়। এই দ্রব্যটি মিহি গুঁড়ো করে রাখতে হবে এবং আধ গ্রাম (সাড়ে তিন রতি) মাত্রায় সকালের দিকে খালিপেটে ও বৈকালে জলসহ খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ অম্লরোগের উপশম হবে। তবে টক, ঝালও খাওয়া বারন।
৮। উদরী রোগেঃ- যে উদরী প্লীহার দোষে এসেছে, সেই ক্ষেত্রে উপরিউক্ত পদ্ধতিতে প্রস্তুত ছাই এক গ্রাম করে নিয়ে তার সঙ্গে একটু পুরানো গুড় মিশিয়ে খেতে হবে। এর দ্বারা ঐ উদর রোগ উপশমের সহায়ক হবে।
৯। মূত্ররোধেঃ- যেকোন কারনে প্রস্রাব আটকে গেলে, তালগাছের কচি শিকড়ের রস দুই বা তিন চা-চামচ, একটু দুধ মিশিয়ে সকালে ও বৈকাল দুবার খেতে হবে, এর দ্বারা ঐ মূত্ররোধ দুর হবে, তবে যেখানে প্রোস্টেট্ গ্লান্ডের বৃদ্ধিতে মূত্ররোধ হয়েছে, সেক্ষেত্রে উপশম হবে না।
মুষ্টিযোগ রূপ ঔষধ প্রস্তুত প্রণালীঃ-
পাকা তালের মজা বা মাড়ি এক কেজি, দন্তী গাছের (Baliospermum montanum) পাতার রস ৫০০ মিলিলিটার, অর্জুনছালের রস ৫০০ মিলিলিটার এবং গুড় ২ কেজি এবং জল ৪ লিটার একসঙ্গে মিশিয়ে একটি পাত্রে (চীনেমাটির পাত্র হলে ভাল হয়) মুখ বন্ধ করে ২১ দিন রাখতে হবে, তারপর একটা মোটা কাপড়ের থলিতে ঢেলে টানিয়ে রাখতে হবে, এই পদ্ধতি গ্রহণ করলে পাতলা (স্বচ্ছ) জলীয়াংশটি ধীরে ধীরে পড়বে, সেই দ্রব্যটিই ঔষধরূপে ব্যবহার করতে হবে।
কোথায় কোথায় কাজ করবেঃ-
১। পুরনো কাসিতে ২। ভরাই হোক আর খালিই হোক, সর্বদা বিবমিষা অর্থাৎ বমি বমি ভাব ৩। পৌরুষ হারিয়ে এখন যেন থাকতেও নেই, সেই অসুবিধেটার ক্ষেত্রে, তার পরবর্তী স্তরে যদিও অগ্রসর হওয়া গেল, আবার হয়েও অপ্রস্তুত তারপরেই বুক ধড়ফড় আরম্ভ হয়, এই ধরনের ক্ষেত্রে। এস সব কিছুকেই কেন্দ্র করে থাকে ইন্দ্রিয়ের দুর্বলতা। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সকালের দিকে ৩/৪ চা চামচ এবং রাত্রিতে শোয়ার আগে ৩/৪ চা চামচ এই রস্ একটু দুধ মিশিয়ে খেতে হবে।
সূত্রঃ-
চিরঞ্জীব বনৌষধী
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য
৩য়-খন্ড, পৃষ্ঠা-১৪৭
মাহমুদুল হক ফয়েজ
মুঠোফোনঃ ০১৭১১২২৩৩৯৯
e-mail:- mhfoez@gmail.com
--Foez 19:15, 6 June 2013 (UTC)