জাল দলিল:নোয়াখালী প্রেক্ষিত
জাল দলিল : নোয়াখালী প্রেক্ষিত
জাল দলিল : নোয়াখালী প্রেক্ষিত
মাহমুদুল হক ফয়েজ</Font.>
ভূমির মালিকানার জন্য দলিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র দীর্ঘ দিন ধরে নোয়াখালীতে এই দলিল জাল করার কারবার করে যাচ্ছে। বিদ্যমান ভূমি আইন ও ভূমি প্রশাসনের নানান অসংগতির সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর সংঘবদ্ধ চক্র ‘জাল দলিল’ তৈরি করে নোয়াখালীর ভূমি ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলেছে। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত মালিকরা হয়রাণির শিকার হচ্ছেন।
১৯০৮ সালের রেজিস্ট্রি আইনে বলা হয়েছে কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর কিংবা বিক্রি যদি একশ’ টাকায় হয় অর্থাৎ কোনো সম্পত্তির মূল্য যদি একশ’ টাকার মধ্যে হয় তাহলে সে সম্পত্তি কেনাবেচায় কোনো রেজিস্ট্রেশন প্রয়োজন হবে না; সংগত কারণে রেজিস্ট্রি অফিসে এ ধরনের জমির কোনো প্রমাণ রাখার প্রয়োজন হবেনা। আইনের সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে এক্ষেত্রে যে কেউ কোনো বিতর্কিত জমির ত্রিশ চলি¬শ বছর পূর্বের একটি কাগজে একশ’ টাকার কম মূল্য দেখিয়ে ‘লিখিত দলিল’ বানিয়ে ঐ জমির মালিকানা দাবী করতে পারবে। এ বিষয়ে আইনে বলা হয়েছে ত্রিশ বছর পর্যন্ত সাক্ষ্য আইনের আওতায় যে কারো দস্তখত চ্যালেঞ্জ করা যাবে, কিন্তু ত্রিশ বছর পর সেটি আপনাতেই বৈধ হয়ে যাবে। তার মানে আজকে যদি কেউ ত্রিশ বছর পূর্বের কোনো কাগজ দেখিয়ে নাম দস্তখত করে তাহলে ঐ দলিলের বিরুদ্ধে আপিল করার কোনো সুযোগই থাকলো না। আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে এভাবে অবৈধ দলিল তৈরির সুযোগ রয়ে গেছে। নোয়াখালী অঞ্চলে এরকম জাল দলিল নিয়ে অসংখ্য মামলা চলমান রয়েছে বলে আইনজীবিরা জানিয়েছেন।
নোয়াখালী অঞ্চলে একটি সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্র জাল দলিল তৈরির কাজে সক্রিয় রয়েছে। আশি কিংবা নব্বই বছর পূর্বে নোয়াখালীর যে জমির দাম ছিল আশি টাকা এখন সেই জমির মূল্য দাঁড়িয়েছে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার বেশি। বিবাদমান কোনো জমির একশ’ টাকার নীচে দেখিয়ে অনেকেই দাবী করে বসছে ঐ ভূমি তার পূর্ব পুরুষ ৮০ কিংবা ৯০ টাকায় খরিদ করেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে কারো কারো দাবী টিকেও যাচ্ছে। এসব ঘটনায় তারা আশ্রয় নিচ্ছেন জাল দলিল তৈরির জালিয়াত চক্রের কাছে; এরা মোটা অঙ্কের বিনিময়ে জাল দলিল তৈরি করে দিয়ে থাকেন। জালিয়াত চক্র পুরোনো দিনের কাগজ অথবা পুরাতন স্ট্যাম্প কিংবা কার্টিজ পেপার সংগ্রহ করে জাল দলিল বানিয়ে দিচ্ছেন। এই ‘জাল দলিল’ এতটাই নিখুঁত যে প্রায় ক্ষেত্রে আদালতও তা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
এই পুরানো দলিল তৈরির লাভজনক ব্যবসা(!) যারা করেন তারা অনেক দিনের পুরানো কাগজ সংগ্রহ করে রাখেন। কারণ ত্রিশ চলি¬শ বছরের পুরানো কাগজ বর্তমান সময়ের কাগজের মতো হবে না। এসব পুরানো ব্যবহৃত দলিল ভালোভাবে ধূয়ে কালি উঠিয়ে সে কাগজে আবার নতুন করে লেখা হয়। এর জন্য একটি বিশেষ কেমিকেল ব্যবহার করা হয়। পুরানো এই দলিলের কাগজে পুরানো b¤^i থাকায় এটি আরো গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠে। এছাড়া তারা নতুন কাগজকেও পুরোনো কাগজ হিসেবে চালানোর কৌশল গ্রহণ করে; এক্ষেত্রে তারা কাগজটিকে অল্প আগুনের তাপে বিশেষ কায়দায় ধরে কিংবা বিশেষভাবে ধোঁয়া দিয়ে পুরানো কাগজের আদল তৈরি করেন। তারপর ঐ কাগজকে উইপোকার ঢিবিতে রেখে বুঝানো হয় এই দলিল অনেক পুরানো এবং দলিলটি উইপোকায় খেয়ে ফেলেছে। আবার কাগজের স্থানে স্থানে বিশেষভাবে কেমিকেল দিয়ে ফুটো করে বিশ্বাস আনা হয় যে উইপোকা দলিল নষ্ট করে ফেলেছে। এই রকম দলিল তৈরি করলে জালিয়াত চক্রের কাছ থেকে উচ্চ মূল্যে গ্রাহকরা তা কিনে নেন। যারা জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত তারা গ্রাহকদের মনমতো দলিল বানিয়ে থাকেন। এর জন্য দশ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকাও নেয়া হয়। এ ধরনের জাল দলিল নোয়াখালীর কোর্ট কাছারীতে প্রায়ই দেখা যায়।
নোয়াখালীর আদালতপাড়ায় একটি মুখরোচক গল্প প্রচলিত আছে যে, শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডায় কাঁপা কাঁপা হাতে সই জাল করা হয়। এ ধরনের জাল দলিলকে ‘মাঘ মাসের দলিল’ বলা হয়।
এই জাল দলিলের কারণে এ অঞ্চলে অসংখ্য মামলা মকদ্দমার উদ্ভব হচ্ছে। জালদলিল এখন দূরারোগ্য ক্যান্সারের মতো নোয়াখালীর সমাজ দেহে ছড়িয়ে পড়েছে। এই জাল দলিলের ফাঁদে পড়ে কত মানুষ যে তার সহায়-সম্পত্তি হারিয়েছেন তার হিসাব নেওয়াও কষ্টকর।
উপরোক্ত বিষয়গুলো করা হচ্ছে নিবন্ধনকৃত নয় এমন দলিলের ক্ষেত্রে। কিন্তু রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রিকৃত দলিলও অনেকক্ষেত্রে জাল করা হচ্ছে। এই সকল জালিয়াতি চক্রের সাথে সরকারি দপ্তরের কর্মচারী ও কর্মকর্তারা জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। কোনো দলিল রেজিস্ট্রি অফিসে রেজিস্ট্রি হলে তা রেকর্ড রুমে সংরক্ষিত থাকে। জেলার রেকর্ডরুমগুলোতে দেখা যায় অনেক বালাম বইয়ের পৃষ্ঠা সংশ্লি¬ষ্ট বইয়ে নেই বা ছেঁড়া। কোথাও কোথাও দেখা যায় কালি দিয়ে লেপ্টে দেয়া আছে। দেখা যায় সরকারি কর্মচারীদের যোগসাজসে জালিয়াত চক্র বালাম বইতে যে b¤^iwU পৃষ্ঠার কোনো রেফারেন্স নাই সেই সব পৃষ্ঠার b¤^i দিয়েই জাল দলিল তৈরি করছে। কেউ কোনো চ্যালেঞ্জ করলে দেখা যায় ঐ বালাম বইয়ের পৃষ্ঠাটি নষ্ট বা ছেঁড়া। অথচ সেই পৃষ্ঠা কোনোদিনই কেউই খুঁজে পাবে না।
নোয়াখালীর আদালত পাড়ায় জাল দলিল বিষয়ে ‘কসবার দলিল’ বলে একটি মুখরোচক কথা প্রচলিত রয়েছে। কোনো দলিল জাল বলে সন্দেহ হলেই সেই দলিলকে আইনজীবী ও সংশি¬ষ্ট ব্যক্তিরা সেটিকে কসবার দলিল বলে থাকেন। পরে নোয়াখালীতে বেশ কিছু দলিল আদালতে দাখিল করা হয় যা ছিল কসবা রেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধনকৃত। এর পরিমাণ একসময় বেশ বেড়ে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কসবা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস আগুনে পুড়ে ভস্মিভূত হয়ে যায়। সেই অফিসের বালাম বইসহ কাগজপত্র রেকর্ড সম্পূর্ণই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ সুযোগটি গ্রহণ করে জালিয়াত চক্র। তারা পুরানো কাগজপত্র দিয়ে সেই কসবার অফিসের উপর জাল দলিল তৈরি করে। সেই দলিল যাচাই বাছাই করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ রেকর্ড বই বলতে কোনো কিছু অবশিষ্ট না থাকায় আদালত যাচাই বাছাইয়ের জন্য তদন্ত করতেও পারে না।
সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত নীতিমালাটি খুবই ত্রুটিপূর্ণ। নোয়াখালীর চরাঞ্চলে খাস জমি বন্দোবস্তের জন্য দ্বৈত পদ্ধতি চালু রয়েছে। একদিকে প্রশাসন অন্যদিকে চর উন্নয়ন সংস্থা ‘সিডিএসপি’। দেখা যায় একই জমি একবার প্রশাসন বন্দোবস্ত দিয়েছে একজনকে, আবার সিডিএসপি দিয়েছে অন্যজনকে। এভাবে একই জমি দু’জন বা দু’পক্ষকে দিয়ে দেওয়ায় অনেকক্ষেত্রে সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। আইনজীবীদের ভাষ্য থেকে জানা যায়, নোয়াখালী আদালতে এ রকম কয়েক’শ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চরাঞ্চলের খাস জমি নিয়ে সবচেয়ে বেশি জাল দলিল তৈরী হচ্ছে। প্রশাসনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালীরা বিভিন্নভাবে জাল দলিল তৈরি করে সরকারি ভূমি গ্রাস করে নিচ্ছে।
জাল দলিল নোয়াখালীর পুরো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে কলুষিত ও বিতর্কিত করে ফেলেছে। জাল দলিলের জন্য অনেক ক্ষেত্রে এ ব্যবস্থাপনাটি স্থবির ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আইনজীবী, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংশি¬ষ্ট কর্তাব্যক্তি এবং ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস ও সেটেল্টমেন্ট অফিস একই মন্ত্রণালয়ে এবং একই ব্যবস্থাপনায় রাখা, সকলের ক্ষেত্রেই রেজিস্ট্রিকরণের সময় টিপসই গ্রহণ ও সংরক্ষণ করা, ভূমি রেজিস্ট্রেশন ও রেকর্ড সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত আধুনিক পদ্ধতির আওতায় আনা এবং সর্বপরি জাল দলিল প্রণেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলে এ থেকে নিষকৃতি পাওয়া যাবে বলে ভুক্তভুগীরা জানিয়েছেন।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
গবেষক, গণমাধ্যম কর্মী
দৈনিক প্রথম আলো, 12 December, 2oo8
--Foez 01:12, 28 January 2010 (UTC)