জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর উন্নয়নে স্থবিরতা

From WikiEducator
Jump to: navigation, search



জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর উন্নয়নে স্থবিরতা


'জলাবদ্ধতায় নোয়াখালীর উন্নয়নে স্থবিরতা

মাহমুদুল হক ফয়েজ</Font.>



জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি ব্যবসা বানিজ্য সহ সার্বিক উন্নয়নে নোয়াখালীতে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর জন্য নোয়াখালীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নোয়াখালী খাল দায়ি বলে সর্বস্তরের জনগণ এবং বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন। জল নিষ্কাশন যোগাযোগ সেচ ইত্যাকার সামগ্রিক প্রয়োজনে নোয়াখালী খালটি ছিলো এ অঞ্চলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ খালটি ছিলো মূলত: প্রবহমান একটি খরস্রোতা নদী। মেঘনার ডাকাতিয়া নামের শাখা নদী থেকে নানান ভাবে এঁকেবেঁকে নোয়াখালীর মধ্যদিয়ে দক্ষিণে সাগরে এসে মিশেছে। নোয়াখালী খাল হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের জনবসতির উপর এক ব্যাপক প্রভাব ফেলে আসছে। এ খালটিই ছিল একদিন নোয়াখালীর জনগণের জন্য স্বর্গীয় আর্শীবাদ। কিন্তু এ খালটি এখন উপকূলীয় এ জনগণের দুর্ভোগের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিমাটি সমৃদ্ধ নতুন ভূমি সাগর থেকে জেগে ওঠার ফলে সাগর যত দেিণ সরে গেছে ততই উজানে এ খালের তলদেশে পলি জমে জমে ভরাট হয়ে গেছে। দীর্ঘ প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এ খাল সংস্কার করার কথা থাকলেও এর জন্য কেউ কখনো কোনো কার্যকর পদপে নেয়নি। ফলে এ অঞ্চলের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার নির্মম শিকারে নিপতিত হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে বিপুল জনগোষ্ঠী। চীনের হোয়াংহো নদীকে যেমন চীনের দুঃখ বলা হয় তেমনি নোয়াখালী খালকে ‘নোয়াখালীর দুঃখ’ বলে অভিহিত করা হয়। নোয়াখালী খালটি ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে পানি নিষ্কাশনের কার্যকারিতা চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। নোয়াখালী খালসহ জেলার বিভিন্ন সংযোগ খালগুলোও এভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে ব্যাপক জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালী জেলাবাসীর জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। খালের মুখে পলি মাটি জমে বিপুল পরিমাণ আবাদী জমির চাষাবাদ সম্পূর্ণরুপে বন্ধ হয়ে গেছে। এজন্য প্রায় কয়েকশ’কোটি টাকার ফসল উৎপাদন থেকে জেলাবাসী বঞ্চিত হচ্ছে। এ সমস্যা নিরসন করতে সত্তর দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন র্বোড একটি প্রকল্প হাতে নেয়। সে প্রকল্পে রহমত খাল এবং নোয়াখালী খালের ভাটিতে দুটি রেগুলেটর নির্মাণ এবং খালের ভাটিতে দুটি শাখা খাল পুনঃখননের পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রকল্পে রহমত খালের ভাটিতে লীপুরের মোজ্জার হাটে একটি রেগুলেটর নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নোয়াখালী খালের প্রস্তাবিত রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখননের কাজ আজ পর্যন্ত করা হয়নি। ওয়াপদা খালটি বেগমগঞ্জের চৌমুহনী রেল স্টেশনের প্রায় এক কিলোমিটার দেিণ আটিয়া বাড়ী রেলওয়ে ব্রীজটি ওয়াপদা খাল এবং নোয়াখালী খালের সংযোগ স্থানে খালের উজান হিসাবে চিহ্নিত। উজান হতে খালের দেিণ মেঘনা নদী পর্যন্ত নোয়াখালী খালের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৬ কিলোমিটার। সেখান থেকে দেিণ ভাটি পর্যন্ত উজানের অনেকগুলো খালসহ ভাটি অঞ্চলের বিভিন্ন পোল্ডারের খাল গুলো নোয়াখালী খালে এসে সংযুক্ত হয়েছে। জেলা সদরসহ সুধারাম, কোম্পানীগঞ্জ ও বেগমগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকার পানি নিষ্কাশনের জন্য খালটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পলি মাটিতে নোয়াখালী খালের এক বিরাট অংশ বিশেষ করে মাঝামাঝি এবং ভাটির অংশ বিশেষ ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে খালের পানি নিষ্কাশন মতা দারুণভাবে লোপ পাওয়ায় নোয়াখালীর উপকূলের ব্যাপক এলাকা জলাবদ্ধতায় প্রকট আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে সমগ্র চাটখিল, বেগমগঞ্জ ও সদরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চল খুবই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সুধারাম থানার সোন্দলপুর, নেয়াজপুর, নরোত্তমপুর, ঘোষবাগ, বাটাইয়া এবং চাপরাশির হাটের ব্যাপক জমি সারাবছর পানিতে তলিয়ে থাকে। এজন্য এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে দীর্ঘদিন থেকে খাদ্যাভাবে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে । কোন কোন এলাকার মানুষজন জায়গা জমি থাকা সত্ত্বেও মুটে মজুরী করে অমানবিক জীবনের কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হচ্ছে। অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র গিয়ে অসহায়ের মত দিন কাটাচ্ছে। এসব এলাকায় সরজমিনে গেলে দেখা যাবে ভরা চাষের মৌসুমেও গ্রামের পর গ্রামগুলো নীরব নিস্তব্ধ হয়ে আছে। আশির দশক থেকে এপর্যন্ত বিভিন্ন সময় অপরিকল্পিতভাবে কাজের বিনিময়ে খাদ্য প্রকল্পের অধীনের এ খালের কিছু পুনঃখননের কাজ হাতে নেয়া হয়। কিন্তু এলাকাবাসীর মতে এতে সময় এবং বিপুল অর্থ ও গমের অপচয় ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এখন দিন দিন এর অবস্থা আরও অবনতি হচ্ছে। ভাটিতে কোন রেগুলেটর নির্মিত না হওয়ার ফলে খালের বিরাট অংশ পলিমাটিতে ভরাট হয়ে যায় এবং সময়ে সময়ে প্রচন্ডভাবে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে মানুষের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। এদিকে সুধারাম, বেগমগঞ্জ ও কোম্পানীগঞ্জের এ গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরিপ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে পোল্ডার ৫৯/১ এ এবং ৫৯/১ বি বেড়ী বাঁধের সংযোগস্থল সোনাপুর এলাকার দক্ষিণে কমপক্ষে ১৫ কিলোমিটার ভাটিতে গাংচিলে বড় আকারের একটি রেগুলেটর নির্মাণ পোল্ডার ৫৯/৩ বি এবং ৫৯/৩ সি সংযোগ বেড়ী বাঁধসহ কোজার ড্যাম নির্মাণ এবং প্রয়োজনীয় লুপ-কাট সহ ৩০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের প্রস্তাব করে নোয়াখালী খাল পুনঃখনন এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প তৈরী করে। কিন্তু এ প্রকল্পটি আজ অব্দি বাস্তবায়িত না হওয়ায় নোয়াখালী উপকূলীয় অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। এককালে নোয়াখালী খাল ছিলো প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা একটি বহমান নদী। মাঝি-মাল্লাদের ভাটিয়ালী সুরের ধ্বনীতে মানুষের মন জুড়িয়ে যেতো। রং-বেরংয়ের পাল তোলা নৌকার সারি ছুটে যেত এর বুক চিরে। দুর দূরান্তের পণ্যবাহী বজরা চলাচল করত এ খালে। কিন্তু বিগত যৌবনা নিস্তরঙ্গ জলকন্যার সেই রূপ এখন কেবলই ধূসর স্মৃতি হয়ে জেগে আছে। বর্ষাকালে এ খালে জোয়ারভাটা হত, শোঁ শোঁ শব্দে উচুঁ হয়ে ধেয়ে আসত স্রোত। অথচ আজ জোয়ারের পলি মাটিতে বিলীন হয়ে গেছে খালের অস্তিত্ব। আবার মরার উপর খাড়ার ঘা হিসাবে উন্নয়নের নামে নীচু করে তৈরি করা হয়েছে অনেক গুলো সেতু। সে সেতুর নীচ দিয়ে এখন কোনো নৌকা যেতে পারেনা। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে নৌ যোগাযোগ বেকার হয়ে পড়েছে ল ল মাঝি মাল্লারা। নোয়াখালী খাল ভরাট হয়ে পড়ায় জেলার হাতিয়া দ্বীপ ছাড়া সমগ্র জেলার প্রায় দু’শ কিঃ মিঃ বিস্তীর্ণ পানি নিষ্কাশনের পথ গুলো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে পড়ে। নোয়াখালীর চরাঞ্চলে যেখানে কোনোদিন জলাবদ্ধতা ছিলোনা সে সব এলাকাতেও জলাবদ্ধতার তীব্র প্রকোপ শুরু হয়েছে। সেখানে প্রভাবশালীরা প্রবহমান খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করছে। নিস্তেজ হয়ে পড়েছে পানি প্রবাহ। আজ আর নোয়াখালী খালে জোয়ার আসে না, খাল দিয়ে পানি মেঘনা নদী হয়ে সমুদ্রে যায়না। শুষ্ক মৌসুমে পুরো খাল একেবার শুকিয়ে যায় আবার বর্ষা মৌসুমে পানিবন্দী অবস্থায় আটক থাকে। খালের মুখে একটি বড় আকারের রেগুলেটর নির্মাণ এবং খাল পুনঃখনন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেই আশা করা হচ্ছে জনগণের দুঃখ লাঘব হবে। এদিকে নোয়াখালী শহরের জলাবদ্ধতা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই রাস্তা ঘাট সহ শহরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এর কারণে শহরবাসীর দুর্ভোগও চরমে উঠেছে। নোয়াখালী শহরের পানি নিষ্কাষনের ব্যবস্থা এখন একটি ট্যাকনিক্যাল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ শহরের পানি নিষ্কাষনের জায়গাগুলো চিহ্নিতকরণ নানান প্রতিকুলোতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। শহরের পানি মূলত: বিভিন্ন দিক দিয়ে নোয়াখালী খালে গিয়ে পড়ে। এখন সে খালটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শহরের পানি নিষ্কাষনেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে। শহরের মাঝামাঝি গুপ্তাংক থেকে হরিণারায়ণ পুর হয়ে ছাগল মারা খাল, বক্সিমিজির পোল থেকে পশ্চিমে মালেক খাল, উত্তরদিকে পুলিশ লাইনের পাশ দিয়ে গাবুয়া খাল মুখী নালাগুলো কিছু অবিবেচক মানুষের কর্মকান্ডে দৃশ্যত: প্রায় বিলিন হয়ে গেছে। সেখানে রাস্তা, বাড়িঘর ও দোকানপাট নির্মানের কারণে জলাবদ্ধতা প্রকট রুপ ধারণ করেছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে শহর পানিতে থৈ থৈ করে। হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায় পাড়া মহল্লা। নষ্ট হয় রাস্তাঘাট সহ অবকাঠামো। ক্ষতি হয় কোটি কোটি টাকার। মূল নোয়াখালী শহর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে পঞ্চাশের দশকে মাইজদীতে নোয়াখালী শহর স্থানান্তরিত করা হয়। এ শহরে নোয়াখালীর প্রাচীন ঐতিহ্যের কিছুই নেই। বসবাসের জন্য একটি নিরাপদ শহর হিসাবে সর্বত্র সুপরিচিত । এখন এটি একটি সুন্দর মনোরম শান্ত বর্ধিষ্ণু শহর হিসাবে গড়ে উঠছে। ভৌগোলিক দিক দিয়েও এর গুরুত্ব বাড়ছে। শহরের জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন করতে পারলে শহরটি দণি পূর্ব বাংলার একটি অনিন্দ্য সুন্দর পর্যটন নগরী হিসাবে গড়ে উঠতে পারে।

মাহমুদুল হক ফয়েজ


--Foez 01:32, 30 December 2009 (UTC)