উপকূল জুড়ে সারি সারি বৃক্ষের লাশ
উপকূল জুড়ে সারি সারি বৃক্ষের লাশ
উপকূল জুড়ে সারি সারি বৃক্ষের লাশ
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র উপকূল জুড়ে বৃক্ষ নিধনের উৎসব চলছে। নোয়াখালীর উপকূল, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এবং কক্সবাজারের টেকনাফের উপকূলে বৃক্ষ নিধনের এক মহাযজ্ঞে বিলীন হয়ে গেছে শত সহস্র গাছ। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু বৃক্ষের দেহে প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন। প্রাণ আছে যার সেই প্রাণী। গাছের প্রাণ আছে সেই অর্থে গাছও প্রাণী। এই প্রাণীর দেহ থেকে প্রাণ চলে গেলে সে হয়ে যায় মৃত। সেই মৃত দেহকে আমরা লাশ বলে আক্ষায়িত করে থাকি। প্রাণহীন গাছ তাহলে লাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনো মানুষ মৃত অবস্থায় পড়ে থাকলে তার লাশ দেখে আতঙ্কিত হই। কিন্তু কোনো বৃক্ষের লাশ দেখে আমরা আতঙ্কিত হইনা কেন! সে লাশের সংখ্যা যদি হয় হাজার হাজার এমনকি লক্ষেরও উপরে। সে বৃক্ষদের মৃত্যু যদি হয় লোভাতুর কোনো গোষ্ঠীর খড়গ কুঠারে। তাহলে তো সেটি হবে একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড। সে হত্যাকান্ডের খুনীদের দোষী সাব্যস্ত করে কেন বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবেনা! একজন বৃক্ষ প্রেমিক পরিবেশবাদী কর্মী হিসাবে যে কেউ এ প্রশ্নটি সামনে তুলে ধরতে পারে।
বৃক্ষ মানুষের কত ভাবে উপকারে আসে তা বলে শেষ করা যাবেনা। নোয়াখালীর উপকূলে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসেই বার বার আঘাত হেনে যখন ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছিল তখন উপকূলীয় সবুজ বনায়ন করে একটি সুরতি বেষ্টনী নির্মান করা হয়েছিলো। সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলের মানুষদের রক্ষায় সে বনভূমি ছিলো অনন্য। নোয়াখালীর উপকূলে কয়েক লক্ষ একর জুড়ে নতুন জেগে উঠা চরে বন বিভাগ এই সব বন সৃজন করেছিলো। সেখানে শুধু বনই সৃষ্টি করা হয়নি, দৃষ্টি নন্দন সেই বনভূমি পর্যটনের এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। এক শ্রেণীর লোভাতুর হিংস্র মানুষের উন্মত্ততায় নি:শেষ হয়ে গেছে সে বনভূমি। এখন সেখানে খাঁখাঁ করছে বিরান চর। অনেক জমিই দখল হয়ে গেছে অবৈধ চিংড়িঘের মালিকদের সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতে। পতেঙ্গায় প্রভাবশালীরা জাহাজ ভাঙ্গার শিল্প গড়ে তুলতে কেটে ফেলেছে শত শত গাছ। টেকনাফে জমির পট তৈরী করার জন্য কেটে ফেলেছে বিশ সহস্রাধিক ঝাউ গাছ। এগুলো পত্র পত্রিকায় বড় করে এসেছে। কিন্তু এর আড়ালে প্রতিনিয়ত চলছে বৃক্ষ নিধনের যজ্ঞ। নোয়াখালীর উপকূলে এ ঘটনা আরো ভয়াবহ। অভিযোগ রয়েছে বৃক্ষ নিধনে প্রভাবশালীরা যেমন সক্রিয় তেমনি বন বিভাগের এক শ্রেণীর কর্মকর্তার নিবিড় যোগ সজাগ রয়েছে এ কাজে। গাছের টাকায় এ সব কর্ম-কর্তারা লাল হয়ে উঠছেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একজন ‘বনের রাজার’ কর্মকান্ড দেশবাসি প্রত্যক্ষ করেছে।
বৃক্ষকে কেমন করে ভালোবাসা যায় তা দেখা গেছে নোয়াখালীর এক নিসর্গ প্রেমিকের ছোট্ট একটি বৃক্ষ খামারে। তার খামারের এককোণে ত্রিশ শতাংশ জমিতে নানান জাতের গাছ রোপন করে তিনি লিখে রেখেছেন ‘প্রতিটি বৃক্ষ আমার প্রাণ, প্রতিটি পত্রক আমার নি:শ্বাস’। সেই গাছ গাছালী নানান জাতের পাখির অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। সে গাছগুলো আয়ের একটি উৎসও বটে। গাছের সঙ্গে পাখির একটি নিবিড় সম্পর্ক জড়িত রয়েছে। একবার ঘর মেরামতের জন্য একটি গাছ কাটার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো তাঁর। গাছ কাটার জন্য লোকজন ঠিক করা হলো। গাছ কাটতে গিয়ে দেখা গেলো সেই গাছে দুটি পাখি বাসা বেঁধেছে। পাখিদের আশ্রয় হারানোর বেদনা অনুভব করে তখন তিনি সে গাছ না কেটে সেদিনের মুজুরী দিয়ে লোকজনদের বিদায় করে দিলেন। সব গাছে সব পাখি বাসা বাঁধেনা। চিল শকুন বাসা বাঁধতো উঁচু গাছে। সে গাছ গুলো নির্বিচারে কেটে ফেলার ফলে চিল শকুন এখন দেশ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। নোয়াখালীর বন বিভাগ সামাজিক বনায়ন এবং উপকূলীয় সবুজ বনায়নের আওতায় যে বন সৃজন করা হয়েছে তাতে অধিকাংশই মেহগনি, একাশিয়া, শিশু প্রভৃতি বিদেশী জাতের গাছের সংখ্যাই বেশী। এর মধ্যে দেখা গেছে মেহগনির আধিক্য। মেহগনির পাতা বিষাক্ত। শীতে পাতা ঝরে পড়ে। এ পাতা কোনো পশু খায়না। এ পাতায় রয়েছে উগ্র তিক্ত গন্ধ। তাই এ গাছে পারতপক্ষে কোনো পাখিও বাসা বাঁধেনা। গাছের শিকড়ে ও পাতা পড়ে মাটি বিষাক্ত হয়ে উঠে। তাই এর আসে পাশে জলাধারে মাছের বিচরণও কম। অনুসন্ধানে দেখা গেছে নোয়াখালীতে এক সময় প্রচুর গবাদি পশু আর পাখ পাখালীতে ভরা ছিলো। মাঠে মাঠে ছিলো গৃহস্থের গবাদি পশুর বিচরণ। খালে বিলে ছিলো নানান জাতের মাছ। এখন তা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। এর জন্য বিদেশী জাতের এই সব গাছের কোনো ভূমিকা আছে কিনা তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এ সব গাছও আমাদের প্রয়োজন। এ গাছ থেকে আসে উৎকৃষ্ট জাতের কাঠ। এ সব গাছের বনায়ন কিভাবে কোন প্রকৃয়ায় করতে হবে বন বিভাগের উচিত জনসাধারণকে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা দেয়া।
নোয়াখালী শহরের উপকণ্ঠে গণপূর্ত অফিস সংলগ্ন একটি জায়গায় এক সময় ছিলো একটি ছোট্ট মন্দিরের পাশে বড় একটি বটগাছ। বহু যুগ ধরে সে গাছে বাসা বেঁধেছিলো কয়টি চিল শকুন পরিবার। আর ছিলো নানান জাতের পাখি। বেশ কয় বছর আগে সে বট গাছ কেটে ফেলা হয়। তার জায়গায় গড়ে উঠেছে দোকানপাট। বট গাছ না থাকায় চিল শকুন সেখানে আর নেই। তবে আশেপাশের গাছ গাছালিতে বাসা বেঁধে আছে নানান জাতের অসংখ্য পাখি আর কাক। শত বছর ধরে পাখিরা এখানে বাসা বেঁধে আছে। সন্ধ্যার মুহূর্তে পাখিরা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। তখন পাখিদের কলতানে সমগ্র এলাকা মুখরিত হয়ে উঠে। পাশেই মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের সুরেলা আজান, পাখির কলকাকলি আর মন্দিরের সন্ধ্যা পূজার মৃদু ঘন্টা ধ্বনি সব মিলিয়ে অপূর্ব এক শব্দ ব্যঞ্জনার আবেশ তৈরী হয়। সেই সাথে পশ্চিম আকাশের লাল আভায় প্রকৃতির অপরূপ স্নিগ্ধতার পরশ ছুঁয়ে যায়। মানুষ পশু আর পাখিদের মত গাছ যদি জীবন্ত না হতো তাহলে এই রকম দৃশ্য কোনো দিনও সম্ভব হোতোনা। মানুষের বিবেচনা হীন কর্মকান্ডে সে নিজেই অনুশোচনায় দগ্ধ হয়। যে কোনো হত্যাকান্ডে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের বিধান রয়েছে। বৃক্ষ নিধনের আইনে সামান্য যে বিচারের বিধান রয়েছে তা সঠিক ভাবে কার্যকর করতে পারলে বৃক্ষ নিধন অনেকাংশে লাঘব হবে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে আগামীতে নোয়াখালী বন বিভাগ উপকূল জুড়ে ব্যাপক বনায়নের কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। সে সব বনায়নে অবশ্যই দেশী প্রজাতির গাছ থাকতে হবে। বিষাক্ত কোনো গাছ যেন এই কর্মসূচীতে না থাকে তা কঠোরতার সাথে অনুসরণ করা উচিৎ। শুধু গাছ লাগালেই পরিবেশ রক্ষা হয়না তা আমাদের ধর্তব্যে রাখতে হবে। উপকূল জুড়ে যে বৃক্ষ নিধনের যজ্ঞ চলছে তা বন্ধ করতে শুধু নির্দেশ দিলেই চলবে না। সে নিধনযজ্ঞ কঠোর হাতে দমন করতে হবে।
উপকূল জুড়ে আমরা আর সারি সারি বৃক্ষের লাশ দেখতে চাইনা।
মাহ্মুদুল হক ফয়েজ
গবেষক, গণমাধ্যম কর্মী
e-mail: mhfoez@gmail.com
--Foez 16:13, 13 January 2010 (UTC)