ইলিশের গ্রাম

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

ইলিশের গ্রাম
মাহমুদুল হক ফয়েজ


নাইয়াপাড়া


বৃহত্তর নোয়াখালীর লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর সদর উপজেলা থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে মেঘনার পাড়ে হতদরিদ্র গ্রাম নাইয়াপাড়া। মেঘনা নদীতে মাছ ধরা এ গ্রামের অধিকাংশ লোকের পেশা। পূর্বে মেঘনা নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়তো। তখন এ গ্রামের লোকেরা ছিল স্বচ্ছল। নির্বিচারে কারেন্টজালে ঝাটকা নিধন ও মহাজনী দাদন ব্যবসাসহ বিভিন্ন সমস্যায় বন্দি হয়ে এ গ্রামের লোকেরা আজ নিঃস্ব, দরিদ্র। নাইয়াপাড়ার অধিবাসীদের এখন দুঃখ দুর্দশার অন্ত নেই। এ জন গোষ্ঠিকে বাঁচিয়ে রেখেছে ওদের কিছু অতীত সুখ স্মৃতি।


Elish-Boat.jpg


কষ্টের শ্মশানে পোড়া সোনালি অতীত


রায়পুর উপজেলার চরবংশী ইউনিয়নের হতদরিদ্র একটি গ্রাম নাইয়াপাড়া। প্রায় সত্তর আশি বছর আগে বরিশালের একদল নদী ভাঙা জেলে পরিবার এ গ্রামে এসে আশ্রয় নেয়। সে সময় তারা একেবারে নিঃস্ব সম্প্রদায় ছিলো না। তাদের মূল পেশা ছিলো ইলিশ মাছ ধরা। সে সময় নদীতে পাওয়া যেতো প্রচুর ইলিশ। সে ইলিশ ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি হতো ইলিশ জাল। বড় বড় ফাঁকের এ জালগুলো বাড়ির নারীরা দতার সাথে তৈরি করতো। নদীতে সে জাল ফেললে বড় ফাঁক দিয়ে সহজে চলে যেতো ছোট জাটকা মাছ। জালে আটকা পড়তো বড় বড় ইলিশ। জাটকা গুলো স্বাভাবিক পরিবেশে নদীর মধ্যেই বড় হতো। জেলেরা জাটকা গুলোকে বড় হওয়ার সুযোগ করে দিতো। ইলিশের জীবনচক্রের সাথে জেলেদের জীবন চক্রও পরম নিবিড়তায় জড়িত থাকতো। কারণ এই ইলিশই ছিলো তাদের আয় রোজগারের প্রধান উৎস। তাদের সবার ছিলো বড় বড় ইলিশের নৌকা। ছিলো বড় বড় জাল।
সবার ঘরে ছিলো প্রাচুর্য। সুখে ভরা ছিলো সবার সংসার। এ পাড়ে এসে তারা কারো মুখাপেক্ষী হয়নি। কারো করুনাও ভিক্ষা করেনি। সরকারি কোনো খাস জমিও দখল করেনি। এ পাড়ার বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে কিনে নিয়েছিলো জায়গা জমি। সে জমিতে বানিয়েছিল সুন্দর সুন্দর বাড়ি। গাছ গাছালি লতায় পাতায় ছাওয়া ছিল সে বাড়িগুলো। অথচ মাত্র কয় বছর থেকে তাদের অবস্থার অবনতি হতে হতে তারা আজ নিঃস্ব, দরিদ্র, হতশ্রী। হতাশায় ছেয়ে গেছে তাদের জীবন স্পন্দন।
নাইয়াপাড়ার কাদেরের দোকানের সামনে নাইয়াপাড়ার মানুষেরা অলস সময় কাটায়। অতীতের সুখ স্মৃতি রোমন্থন করে ওরা কখনো হয় আবেগ আপ্লুত, কখনো হয় ক্ষুদ্ধ বিদ্রোহী।

মধ্যম বয়সী মোঃ মোস্তফা জানায়, কিভাবে বরিশাল থেকে নদীর এ পাড়ে তার বাপ চাচারা এসে বসত করেছিলো। মোস্তফা জানায়, আমার পিতা মৃত সুলতান আহম্মেদ ব্যাপারী। এক সময় বরিশালের মেঘনা নদীতে আমাদের বসত ভিটা ভেঙে গেলে প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে এখানে চলে আসে। আমাদের একমাত্র পেশা মৎস্য ধরা। আমরা জেলে সম্প্রদায়। এক সময় আমরা প্রচুর ইলিশ মাছ ধরতাম। এই ইলিশ থেকেই আমাদের জীবন জীবিকা চলতো। আমাদের সুখের সময় একদল মুখোশধারী বন্ধু আসলো। তারা আমাদেরকে আরো লাভ দেখিয়ে লোভী করে তুললো। তারা আমাদেরকে দাদনের জালে জড়িয়ে ফেললো। মোস্তফা জানায়, তাদের অসহায়ত্ব আর সরলতার সুযোগে দাদন ব্যবসায়ীরা কি নির্মম শোষণ করেছিলো। তারা টাকার অংক ঠিকই ধরেছিলো কিন্তু সরাসরি টাকা না দিয়ে, দিয়ে ছিলো মাছ ধরার সরঞ্জাম। সে সরঞ্জামের দাম ধরেছিলো স্বাভাবিক বাজারের দ্বিগুণ তিনগুন। কেউ প্রতিবাদ করলেই নেমে আসতো অমানুষিক নির্যাতন। মোস্তফা জানায়, একশ টাকায় আমাদেরকে দিতো বিশ/পঁচিশ টাকা। যে সুতার দাম ছিলো পাঁচ হাজার টাকা সে সুতার দাম ধরা হয়েছিলো দশ হাজার টাকা, যে কাঠের মূল্য ছিলো সিএফটি পাঁচশ টাকা ঐ কাঠ আমাদের কাছে ধরেছিলো নয়শ টাকা। এই ভাবে দুইদিকে শোষণ করতো তারা। নগদ টাকা না দিয়ে মাল দিয়ে ঋণী করেছে। এই ঋণ পরিশোধ কখনো হতো না। আমরা এখন জড়িয়ে গেছি এক কঠিন ষড়যন্ত্রের জালে। আমরা কিছুই করতে পারিনি। এখন আমরা নদীতে মাছ ধরলেই তারা সামনে এসে দাঁড়ায়।
মোঃ মোস্তফা অফিযোগ করেন, মৎস্যজীবী সেজে এই এলাকার প্রভাবশালী মহর, আবদুল মালেক খান, তার মেজো ভাই দাদন ব্যবসায়ী আলী খান, সহদর ইসমাইল হোসেন দুদু মিয়া মাস্টার, হাজী মোঃ হাওলাদার নদীতে জাটকা ধরছে। তারাই জাটকা নিধনের প্রধান হোতা। তারাই দাদন দিয়ে নাইয়াদের নিঃস্ব করে ফেলেছে। পুলিশ এদের অতি কাছের লোক। পুলিশ আসলে ভেট দিয়ে বিদায় করে। এরা অসাধু ব্যবসায়ী। মোস্তফা আরো জানায় ‘আমরা এখন সর্বশান্ত হয়ে গেছি। দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমরা এখন বাঁচতে চাই। প্রতিবাদ করলে এরা অত্যাচার শুরু করে দেয়। আক্কাস আলী নামে বয়স্ক একজন নাইয়াকে এরা চরম অপমান করেছিলো। গলায় টিনের মালা পরিয়ে এরা তাঁকে রাস্তায় ঘুরিয়েছিলো। তার অপরাধ ছিলো তিনি এই শোষণের প্রতিবাদ করেছিলেন। আমাদের বাপ চাচার কেনা ঘর দুয়ার বেচে এখন ওদের দাদনের টাকা শোধ করতে হচ্ছে। সরকারের প থেকে খাস জমি বন্দোবস্ত দিলে আমরা এখন কিছুটা বেঁচে থাকতে পারবো। ওরা যদি জাটকা ধরা বন্ধ করে তা হলে নদীতে অচিরেই ইলিশ পাওয়া যাবে।



আপনাগো মত সাহেবেরা আইসা আমাগোরে ধ্বংস করছে

আসল কথা কইতে গেলে আপনাগো গায়ে আইসা পড়বো। একটা হইলো আল্লাহ দেয় না। তারপর হইলো ইলিশ মাছের বাচ্চা গুইলা এক ধরনের জাইল্লা আছে তারা মাইরা ফেলায়। এই যে, বাইচ্ছা গুইলা মারে এরা হইল পোয়া জাইল্লা। নেট জাল দিয়া দশটা মাছ ধরে কিন্তু দশ কোটি টাকার মাছ নষ্ট কইরা ফেলায়। আপনাগো মত সাহেব আইস্যা আমাগোরে ধ্বংস কইরছে। তারা জাত জাইল্লা না। জাইল্লার কাজ হইলো সম্মানের কাজ। জাইল্লার কাজ হইলো জ্ঞান বুদ্ধির কাজ। ওরা শুধু লক্ষ লক্ষ টাকার লোভ কইরছে। টাকার দিকে ওগো খেয়াল। নদী কেমনে বাঁইচবো, মাছ কেমনে হইবো ওরা জানে না’।


ক্ষোভে আর কষ্টে কথাগুলো বলছিলেন নাইয়াপাড়ার আক্কেল আলী। বংশ পরম্পরায় এরা মাছ ধরতো। কিন্তু এখন নদীতে মাছ না পাওয়াতে তারা অন্য কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আক্কেল আলী মাছ ধরা ছেড়ে খুলনার অন্য মালিকের ট্রলারে চাকরি নিয়েছেন। পরিবার পরিজন নাইয়া গ্রামেই থাকে। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসেন। মাছ না পাওয়াতে অনেকে ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর গিয়ে বদলার কাজ করে।


আক্কেল আলী জানান, জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত নদীতে বড় ইলিশ থাকে। আষাঢ় শ্রাবণ মাসের ইলিশ থাকে তরতাজা। তারপর এরা ডিম ছাড়ে। ডিম ছাড়ার পর মাছগুলো খুব কাহিল হয়ে পড়ে। নাইয়ারা জানায়, নদীর পানি দেইখা আমরা কইতে পারে ইলিশে ডিম ছাড়ছে। তখন আমরা সাবধানে থাকি। ডিমগুলা যেন নষ্ট না হয় সেই ভাব করি। পোনাগুলা যেন বড় হইতো পারে সেইভাবে নদীতে নৌকা বাই’। মাঘ মাস থেকে বৈশাখ পর্যন্ত জাটকার মৌসুম। এই সময় জাটকা মাছ বড় হয়। সাচ্ছন্দে চলাচল করে। নদীর নির্দিষ্ট কয়টি যায়গায় এর বড় হতে থাকে। বৈশাকের শেষে বৃষ্টি হলে জাটকারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। বর্ষার শুরুতে পানি বাড়লে তারাও দ্রুত বড় হতে থাকে। জাটকার বিচরণ ক্ষেত্রগুলো রক্ষা করতে পারলে হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদী থেকে আহরণ করা যায়। নাইয়ারা বলেন, জাটকা ব্যবসা হিরোইন ব্যবসা থেকেও উর্ধ্বে। কারণ নির্দিষ্ট জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে জাটকারা দলবদ্বধ থাকে। এ সময় জাল ঢেললেই জাটকা উঠে। কিন্তু যারা জাটকা ধরে তাদের বোধ বিচার বলে কিছুই নাই।
যারা জাটকা ধরে তারা আপনাগো মত কোট প্যান্ট পরা সাহেব। এরা আমাগোরে ঘৃনা করে। জাইলার কাজ নীচু কাজ বইলা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। এখন এরা আইসা আমগোরে তো ধ্বংস কইরলই। দেশের সম্পদ ও ধ্বংস কইরা ফালাইছে। আমরা এখন সর্বশান্ত হইয়া কথা কইতে পারি না।



শ্রম শোষণের নির্মম কারাগার

অর্ধশত ছোট বড় জেলে নৌকা। এ নৌকাগুলো দিয়েই নদীতে মাছ ধরতে যেতো জেলেরা। এখন নৌকা নিয়ে নদীতে গেলে শূন্য হাতে ফিরে আসতে হয়। খরচ পোষায় না। অগত্যা অসহায় হয়ে অনেকেই আর নদীতে যায় না। জরাজীর্ন অবস্থায় নৌকাগুলো পড়ে আছে। খসে খসে পড়ছে নৌকার কাঠগুলো। কেউ কেউ সে কাঠগুলো বিক্রি করে ক্ষুধা নিবারন করছে। দারুন দৈন্যতায় দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে ওরা শ্রমদাসে পরিণত হয়েছে। এখন ঋণের আষ্টেপৃষ্টে ওরা বন্দি। আবদুল আজিজ, আবদুল হালিম, মোঃ সায়েদ, মোঃ আবছার, আলাউদ্দিন মাঝি, শফি বকাউল, সামছুদ্দিন ব্যাপারি জানায়, এই জালগুলা আমরাই বানাইছি, জাল বানানোর পর সেই জালে গাব দিয়ে শুকাই। তারপর নদীতে জাল ফেলতে যাই। প্রতি খেপে দশ বার দিন থাকি। আমরা কোনো ছোট মাছ ধরি না। আমরা বড় মাছই ধরি। আমরা আগে নিজেই মাছ ধরতাম। যা পাইতাম তাই হতো আমাদের সম্পদ। এখন দাদন ব্যবসায়ীরা আমাগোরে খপ্পরে ঢেলাইয়া দিছে। কি ষড়যন্ত্রের জাল তারা আমাগোর ওপর ফালাইছে তা আমরা টেরও পাই নাই। নদীতে জাল ফেলাইলেই ওরা সামনে এসে খাওড়ায়। যে মাছ একশ টাকা হেই মাছ হেরা আমগোরে দেয় বিশ টাকা। জুলুম কইরা নেয়। বাধ্য হইয়া দিতে অয়। বহুত আগের দাদন। এই কইরা শোধও হয় না আমরাও মুক্তি পাইনা।
কারা দাদন দেয় জানতে চাইলে জেলেরা জানায়, এলাকার কয়জন প্রভাবশালী দাদন ব্যবসায়ী মালেক খান, আলতাফ মাস্টার, মাহমুদ হালদার এদেরকে দিতে হয়। আগে আছিলাম দাদন বেগর, (দাদন মুক্ত মানুষ) এখন এরা জোরপূর্বক দাদন ঘচাইয়া দিয়া আমাদেরকে দিয়া নদীতে মাছ ধইরতে বাধ্য করায়’।
জেলেরা এখন উপায় খুঁজতে চায় কিন্তু জমি জিরাত নেই। নদীতে মাছ নেই। এই শ্রমজীবী মানুষদের সামনে জেগে উঠছে হাজার হাজার একর খাস জমি। প্রভাবশালীরা লুটে নিয়ে যাচ্ছে সে জমি। অথচ তিল তিল করে নিঃস্ব হতে হতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে একটি শ্রমজীবী সম্প্রদায়। এখন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাই তাদের একমাত্র ভরসা।


এ দ্যাশে ট্যাকা দিলে সব ঠিক

নাইয়াপাড়ার পাশের গ্রামে জন্ম মফিজুর রহমানের। বয়স ৬৫ বছর। কৃষি কাজই মূল পেশা। শৈশব থেকেই নাইয়াপাড়ার সাথে তাঁর সম্পর্ক। মফিজুর রহমান জানান, নাইয়ারা কোনোদিন জাটকা ধরতেন না। জাটকা বলে একটা কিছু আছে তা কেউ জানতো না। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, যারা আইন বানায় হেরাই আইন ভাঙে। এ দ্যাশে টাকা দিলে সব ঠিক। বড় বড় লঞ্চ স্টিমার আইসা জাটকাগুনারে ঢাকা নিয়া যায়। ঢাকায় অরা দেখেন না? আমাদের এখানের বাজারে নিয়মিত জাটকা ওঠে। বাজারের আড়তদাররাই জাটকা ব্যবসায়ী। ওদের বেবাকের লগে কানেকশন। ট্যাকার লেনদেন চলে হেগর লগে। ঘুষখোররা ঘুষরে ঘুষ কয় না, এটা ঘুষ না। তারা কয় পার্র্সিনটিজ,  ইন্টিরিস্ট, বিনিফিট (পার্সেন্টেজ, ইন্টারেস্ট, বেনিফিট)।


অসহায়ত্বের শিকার নাইয়াপাড়ার নারীরা

চরম দুর্দশায় পড়ে অসহায়ত্বের শিকার হয়েছে নাইয়াপাড়ার নারীরা। এক সময় পুরুষরা সবাই যেতে নদীতে মাছ শিকার করতে। নাইয়াপাড়ার বধূঁরা তখন ঘরের নানান কাজে ব্যস্ত রাখতেন নিজেদের। তাদের সবচেয়ে বড় কাজ ছিল নাইয়াদের তৈরি করে দেয়া। মেয়েরাই বানাতো জাল। পুরো জালটাই তৈরি করতো নারীরা। মাছ ধরার যত সরঞ্জাম সবই যোগান দিতো নারীরা।
প্রতি কাটালে মাছ ধরার জন্য জেলেদের ১২/১৪দিন নদীতে থাকতে হতো। সেই সময়ের খাওয়া-দাওয়া থেকে সমস্ত সরঞ্জাম গুছিয়ে দিতো নারীরা। সময় মত উৎসব আনন্দে বিয়ে হতো মেয়েদের। নতুন ঘর বাধার জন্য অন্যরা সহযোগিতা করতো। কিন্তু এখন সে দৃশ্য পাল্টে গেছে। অভাবের প্রথম আঘাতটা লেগেছে নারীর ওপর। অভূক্ত স্বামীহীন জীবনে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা। অভাবের তাড়নায় সোমত্ত মেয়েদের বিয়ে হচ্ছেনা। এমনি এক মেয়ে সাবেরা খাতুন। পচিশ বছর। বাবা হোসেন ব্যাপারি রুগ্ন অসুস্থ। এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন নাইয়া। এখন বদলা দেয়।
পয়সার জন্য মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন। সাবেরা খাতুন অষ্টম শ্রেণীপর্যন্ত পড়েছে। ইচ্ছা ছিল অনেক পড়ালেখা করার। কিন্তু অভাবের জন্য আর পড়া হয়নি। এখন বাবার অভাবী সংসারে বোঝা হয়েই আছে। মা আয়শা খাতুন। আপে করে বলেন, ‘মেয়ে বিয়া লাক হইয়া সময় যাইতেছে’। আমরা তারে বিয়া দিবার পারতাছিনা। বিয়ার জন্য বেবাকে টাকা চায়। টাকা পযসা হইলে জামাই পাওয়া যায়।
ঘরের মধ্যেই নারীদের ছিল নানান ধরণের কাজ। সংসারের নানান টুকটাক কাজ করে ওরা সংসারটাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঈদ পার্বণে নতুন কাপড় পড়ে হাসি আনন্দে ভরে উঠতো ছোট ছোট ঘরগুলো। মেতে উঠতো পাড়া। মাত্র কয় বছরে সে সব আর নেই। এখন অন্যের কাজ করে সামান্য যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে সংসার চলে। কখনো সোয়াবিনের তে পরিষ্কার করা। সোয়াবিন বিচি তুলে দেয়া। সোয়াবিন ভেঙ্গে ঝাড়ানোর কাজ করতে হয় ওদের। নিজেদের জাল নেই। মাঝে মাঝে অন্যদের জাল বুনে দেয় নারীরা। মাছের আকাল। নদীতে মাছ নেই। জীবনেরও আকাল বয়ে যাচ্ছে ওদের।



নাইয়াদের পরিবেশ সচেতনতা


: আমার বাপ দাদা কোনোদিন কারেন্ট জাল দেখে নাই। আমাদের বাপ দাদারা নদীতে ইলিশ মাছ ধরতো। সে ইলিশ মাছের জাল অন্য জালের মত না। আমরা চাঁদপুর থেইকা সুতা কিন্না আনি। সেই সুতা দিয়া আমাদের বৌ ঝি’রা জাল বানায়। মাইয়া শিখছে মায়ের কাছে, মা শিখছে নানীর কাছে এইভাবে একজনের থাইক্কা একজনে শিখা এখন মাইয়ারাই এই কাজ করে। তারাই জানে কেমনে জাল বানাইতে অইবো। জাল বানাইবার সময় জালের ফাঁকগুলা অনেক বড় বড় কইরা বানায়। যাতে ফাঁক দিয়া জাটকা গুলা এপাশ ওপাশ চলাচল করতে পারে। ধরা পড়ে শুধু বড় বড় ইলিশ। জাল গুলাইনরে বানাইয়া আমরা গাবের কষের মাইঞ্জা দেই। দুই রকম গাব আছে গেরামে। একটা অইলো গিয়া বিলাতি গাব, হেগুলো খায়। পাইকলে খুব স্বাদ। আরেক গুলা কস্ গাব। জাইল্লা গাব কয় হেইগুলারে। এই জাইল্লা গাব দেই জালে। গাব গুলারে লইয়া ঢেঁকিতে চুইরা কস কইরা লই। কস্গুলা বড় বড় মোটকাতে পঁচিশ ত্রিশ দিন মুখ বন্ধ কইরা রাইখা ভাল কইরা কসানো হয়। তারপর জালগুলারে হেই কসে ভাল কইরা ভিজাইয়া রোদে শুকাই। এইভাবে কইরলে জালগুলার সুতা খুব ভাল থাকে। জাল সহজে ছিঁড়ে না। বহুদিন জাল টিকে থাকে। এই জাল দিয়া মাছ ধরলে নদীর পানি ভালা থাকে। মাছের রোগ হয় না। মেশিনে যে জাল বাইর হইছে হে গুলান ম্যালা তি করে। আবহাওয়া তি করে’।
এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন আশি বছর বয়সের বৃদ্ধ নাইয়া তাহের আলী ব্যাপারি। ঘরের মেয়েরা জাল বানিয়েছে আর তিনি দাওয়ায় বসে তা জোড়া দিয়ে দিয়ে বেঁধে নিচ্ছেন। বরিশাল থেকে প্রায় ৫৫ বছর আগে বাবা জাহের আলী ব্যাপারির সঙ্গে এ গ্রামে আসেন। নদী আর জাল ছাড়া তিনি আর কিছুই চিনেন না। অন্য কোনো কাজও জানেন না। জালগুলো বানিয়েছে তার স্ত্রী আফিয়া খাতুন। তার তিন মেয়ে পারুল, মাকসুদা, ফাতেমা তারাও জাল বানায়। মায়ের কাছে শিখেছে।
যে নদী ওদের রিজিক দেয়, সে নদী আর মাছের সঙ্গে ওদের জীবনের গাঁথুনী। ওরা জানে নদী আর মাছ টিকে থাকলে ওরাও বেঁচে থাকবে। বংশ পরম্পরায় ওরা শুধু মাছই ধরেনি। প্রজ্ঞা মেধা আর জ্ঞানে নদী আর মাছকেও রা করেছিলো।


ধূলো জঞ্জালে ঢাকা রীণার শৈশব


নাইয়াপাড়ার মা-বাবা হারা রীণা। নাইয়াপাড়ার সবার যখন প্রাচুর্য ছিলো তখন রীণার জন্ম হয়নি। এখন তার বয়স সাত আট বছর। মা-বাবা হারা রীণা বড় ভাই আলতাফ হোসেনের কাছে থাকে। সোয়াবিনের ধূলা জঞ্জালের ভিতর কাজ করে যাচ্ছিলো সে। সন্ধ্যার পরও কুলার মধ্যে সোয়াবিনের দানা ঝেড়ে ঝেড়ে পরিষ্কার করছে। চার মাইল দূরে চর থেকে সারাদিন তপ্ত রোদে পুড়ে সোয়াবিন তুলে ছিলো সে। তারপর আটি বেঁধে মাথায় বোঝা করে এনেছে নাইয়াপাড়ায়। কাজ করছিলো তার বড় বোন খালেদা বেগমের সাথে। খালেদার স্বামী শাহ আলম আজ ক’বছর পঙ্গু হয়ে গেছে। মাছ ধরতে পারে না। তা ছাড়া নদীতে তো মাছই নেই। এখন সোয়াবিন তোলার কাজ করে কোনো রকমে দিন যায়। আলতাফ জানায়, দশ বার বছর আগে তাদের অবস্থা খুব ভাল ছিলো। ইলিশ মাছের আয়ে বাড়িতে সুন্দর চারচালা টিনের ঘর তুলেছিলো। সে ঘর এখন ভেঙ্গে ঝাঁজরা হয়ে আছে। ঘরটি দেখলেই বুঝা যায় ঘর বানানোর রুচিটিও ছিলো সুন্দর। বাবা ছিলো হাফিজ উদ্দিন ব্যাপারি। রীনার জন্মের পরই তিনি মারা যান। কষ্ট আর দৈন্যতায় বেড়ে উঠছে রীনা। এখন অন্য নারীদের সাথে সেও কাজ করে। সারাদিন পায় দশ বার টাকা। স্কুলে একটা নাম লিখিয়েছে। চর বংশী প্রাইমারী স্কুল। কিন্তু স্কুল তেমন যাওয়া হয় না। ছেঁড়া বইয়ের পাতায় জমে ধূলার আস্তর। আগামি স্বপ্ন আর দেখতে পায় না রীনা। এখন ধূলোর জঞ্জালে ঢাকা পড়ে আছে সোনালি শৈশব।


মাহমুদুল হক ফয়েজ

--Foez 19:09, 7 May 2013 (UTC)