User:M. A. Halim/Some my Article in Bangla/মহান একুশ যেভাবে হলো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'

From WikiEducator
Jump to: navigation, search

মহান একুশ যেভাবে হলো 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস'

একুশে ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র দিনপঞ্জীর একটি জ্বলজ্বলে লাল তারিখ নয়, একুশ বাঙালির কাছে এক খাপ খোলা তলোয়ার। বাহান্ন সাল গেছে তো সেই কবে। তারপর পেরিয়ে গেছে বহু বসন্ত। একুশের পথ বেয়ে বাঙালি বারবার দিয়েছে শৈর্য্য-বীর্যের পরিচয়। বাহান্ন'র মাত্র দু' বছর পরে চুয়ান্ন'র সাধারণ নির্বাচনে শাসকদের ভরাডুবি ঘটিয়েছে, বাষট্টির কূখ্যাত হামুদুর রহমান শিা কমিশনের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজ বীর বিক্রমে রুখে দাঁড়িয়েছে। ছিষট্টি'র ছয় দফার আন্দোলন, ঊণসত্তুরের গণ অভু্যত্থান, সত্তুরের সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির ভূমিধস বিজয় এবং একাত্তুরের রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধ সবই এসেছে একুশের পথ বেয়ে। স্বাধীনতা অর্জনের পরেও যেকোন অন্যায়, অবিচার আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দুর্বার বাঙালির জেগে উঠতে একুশই ছিল সদা ভ্যানগার্ড।
একুশের বীর শহীদদের রক্তস্রোতে ভেসে যায় বাঙালির সব দীনতা, হীনতা ও দুর্বলতা। তারা নির্জীব বাঙালি জাতিকে এক অমূল্য শিক্ষা দিয়ে গেছেন। ভয়কে জয় করায় সাহস ও মৃত্যুকে তুচ্ছ করার শিক্ষা। ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইতে পারার শিক্ষা, বুঝতে শিখিয়েছেন 'Only they deserve to live who dare to die'।
রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের বড় সাফল্য ছিল আমাদের বাঙালি পরিচয়কে সুস্পষ্ট করা। রফিক, সালাম, বরকতসহ অসংখ্য নাম-না-জানা শহীদের রক্তবীজ থেকে জন্ম নিল স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তি। মাতৃভাষার জন্য তাদের আত্দত্যাগের ভাস্বর এই দিনটি ১৯৯৯ সালে পেল বিশ্ব স্বীকৃতি।
এখন দেখা যাক বাঙালির গর্ব অমর একুশে ফেব্রুয়ারি কিভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেল।
গত শতাব্দীতে বাঙালি জাতির জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ এবং ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। ২১শে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে' পরিণত করার ভাবনা প্রথমে আসে কানাডার ভাংকুভারে প্রবাসী বাঙালি জনাব রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালামের মাথায়। বাংলা ভাষা রার জন্য বাঙালিরা প্রাণ দিয়েছে, কাজেই তাদের এই অবদানের সম্মানার্থে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে যেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয় এ ব্যাপারে তারা ১৯৯৮ সালের জানুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানকে চিঠি লেখেন। পরে তারা 'Mother Language of the world' নামে একটি বহু ভাষাভাষী সংগঠন গড়ে তুলে এর প থেকে কফি আনানের কাছ আবারো চিঠি পাঠান। ইতিমধ্যে প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেছে। এরপর জাতিসংঘ থেকে দিকনির্দেশনা পেয়ে তারা বিষয়টি প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দফতরে প্রেরণ করেন। সেখান থেকে তাদের ১৯৯৯ সালের এপ্রিল মাসে জানানো হলো, 'তোমাদের বিষয়টি খুবই ইন্টারেস্টিং, ইউনেস্কো এ ধরনের প্রস্তাব পেলে তা আলোচনা করে থাকে। বিষয়টি অক্টোবরে প্যারিসে অনুষ্ঠেয় ইউনেস্কো সম্মেলনে তুলতে হবে এবং তা কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর প থেকে হলে চলবে না, কোনো সদস্য রাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপন করতে হবে।' এরপর রফিকুল ইসলাম ও আবদুস সালাম বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা দিয়ে বাংলাদেশ সরকারের শিা মন্ত্রণালয়ে পাঠান। শিক্ষা সচিব কাজী রকিব উদ্দিন তখন এটা তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী জনাব এএসএইচকে সাদেককে অবহিত করেন। এদিকে হাতে সময় ছিল খুবই কম। কারণ আনুষ্ঠানিকভাবে ইউনেস্কো সদর দফতরে এ প্রস্তাব পাঠানোর শেষ তারিখ ছিল ১০ সেপ্টেম্বর। শিক্ষামন্ত্রী বিষয়টি তাৎণিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে আনেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সময় নষ্ট না করে ত্বরিত সিদ্ধান্ত দেন প্রয়োজনীয় পদপে নেওয়ার জন্য। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক 'ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা সংরক্ষণ' সম্পর্কিত ইউনেস্কোর নীতিমালার আলোকে ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে (২৬ অক্টোবর-১৭ নভেম্বর) ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করা হয়। বাংলাদেশের প্রস্তাবের শেষ বাক্যটি ছিল, Bangladesh proposes that 21st February be proclaimed International Mother Language Day throughout the world to commemorate the martyred who sacrificed their lives on this very date in 1952. প্রস্তাবটি প্যারিসে ইউনেস্কো সদর দফতরে পৌঁছে ৯ সেপ্টেম্বর। অর্থাৎ শেষ সময়ের মাত্র একদিন আগে। এরপর ইউনেস্কো সচিবালয়ে এ প্রস্তাব নিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে বাজেটের কথা বিবেচনা করে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। ইউনেস্কোর মহাপরিচালক Draft Resolution-৩৫ হিসেবে চিহ্নিত বাংলাদেশের প্রস্তাবটির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণের পক্ষে সুপারিশ করেন। তার ভাষ্যটি ছিল এরূপ- The Director General has no objection to this draft resolution. However, it would be advisable to prepare first a feasibility study which could not be accommodated within the existing budget allocation. International Mother Language Day will be carried out and will be submitted to the Executive Board at its next session.
মহাপরিচালকের উপযুক্ত মতামত আমাদের প্রস্তাবটিকে রীতিমতো অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়। এমন হতাশাজনক পরিস্থিতিতে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আনস্নর্জাতিক মর্যাদা লাভের শেষ আশা জাগিয়ে তোলে ইউনেস্কোর অধিবেশনে যোগদানকারী বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। শিামন্ত্রী জনাব সাদেক, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ও ইউনেস্কো মহাপরিচালকের বিশেষ উপদেষ্টা জনাব তোজাম্মেল হকের (টনি হক) কূটনৈতিক প্রজ্ঞা, দতা ও বিচণতা এ ব্যাপারে মূল্যবান অবদান রাখে।
জনাব টনি হক ও রাষ্ট্রদূত মোয়াজ্জেম আলী ইউনেস্কোর ডেপুটি মহাসচিব কলিন পাওয়ারের সঙ্গে সাাৎ করে তাকে বুঝিয়ে বলেন যে, আমাদের প্রস্তাবে যে বিষয়টির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে তা হলো, পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রা করা এবং তা টিকিয়ে রাখার ল্যে বৃহত্তর সচেতনতা গড়ে তোলা। সুতরাং ইউনেস্কোর সচিবালয়ের পরামর্শমতো আমরা যদি Feasibility study করতে যাই তাহলে উদ্যোগটি কমপক্ষে দু'বছর পিছিয়ে যাবে এবং ইত্যবসরে আরো অনেক ভাষার বিলুপ্তি ঘটবে। অষ্ট্রেলিয়ান নাগরিক কলিন পাওয়ার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি খসড়া প্রস্তাবে উলি্লখিত মতামত প্রত্যাহারে রাজি হন এবং নিম্নোক্তভাবে পরিবর্তিত প্রস্তাব বিবেচনার জন্য কমিশন-২-এ (এ ব্যাপারে যথাযথ সংস্থা) পাঠানোর সিদ্ধান্ত দেন।
An International Mother Language Day will be proclaimed with a view to pursuing the organization's work is favor of linguistic and cultural diversity and multilingualism in all fields of competence and that the proposed International Mother Language Day be observed on 21st February every year in the member states and the UNESCO Headquarters. পাকিস্তানসহ ২৮টি সদস্যরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রস্তাবকে লিখিতভাবে সমর্থন জানায়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রস্তাবটি যদি একবার Feasibility Study-র জন্য একজিকিউটিভ বোর্ডে প্রেরণ করা হতো তাহলে আর কোনো দিন তা আলোর মুখ দেখত বলে মনে হয় না।
ইউনেস্কোর টেকনিক্যাল কমিটি কমিশন-২-এ বাংলাদেশের প্রস্তাবটি পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী উত্থাপিত হয় ১২ নভেম্বর। সকাল ১০টায় যথারীতি কমিশন-২-এর কার্যক্রম আলোচ্যসূচি অনুযায়ী শুরু হয়। কমিশনের সভাপতি স্লোভাকিয়ার লুডোভিট মোলনার একের পর এক প্রস্তাব উত্থাপন করছেন_ বিতর্ক হচ্ছে, সংশোধনী আসছে, কোনোটা গৃহীত বা পরিত্যক্ত হচ্ছে। স্থানীয় সময় বিকেল ৩টায় আলোচ্যসূচি অনুযায়ী উত্থাপিত হলো বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক প্রস্তাব (নম্বর ৩০ সি/ডি/আর-৩৫)। বাংলাদেশের প থেকে অতি সুন্দরভাবে প্রস্তাবের প েবক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলন ক েবিভিন্ন দেশের প্রায় পাঁচশ' প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। সভাপতি পর পর দু'বার জিজ্ঞাসা করলেন প্রস্তাবের ওপর কারো কোনো আপত্তি বা মন্তব্য আছে কি না। কারো কোনো আপত্তি না থাকায় সভাপতি তিনবার হাতুড়ি পিটিয়ে প্রস্তাবটি গৃহীত হলো বলে ঘোষণা দিলেন। হাততালিতে মুখরিত হলো সম্মেলন ক।
কমিশন-২-এ পাস হওয়া প্রস্তাবটি ১৭ নভেম্বর সাধারণ সম্মেলনে রুটিন বিষয় হিসেবেই গৃহীত হয়। ৪ জানুয়ারি ২০০০ তারিখে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক কাইচিরো মাটসুরা এক চিঠিতে ইউনেস্কোর সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি তখন থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শুধু মাতৃভাষার জন্য আমাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকেই স্বীকৃতি দেয়নি, অমর একুশের শহীদদের আত্দদান থেকে উৎসারিত স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীনতা অর্জনকেও মর্যাদা দিয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের পৃথিবীর বুকে মহিমান্বিত করেছে। বিশ্বের ১৯০টি দেশে এখন প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' উদযাপিত হচ্ছে। ঐসব দেশের মানুষ জানছে ঢাকার বুকে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কী ঘটেছিল, কী কারণে রফিক, সালামরা প্রাণ দিয়েছিল। তারা আরো জানবে বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস। এটা যে জাতি হিসেবে আমাদের জন্য কত বড় অর্জন তা ভাবা যায় না।