মাইজদী যখন নোয়াখালী

From WikiEducator
Jump to: navigation, search



মাইজদী যখন নোয়াখালী


মাইজদী যখন নোয়াখালী

মাহমুদুল হক ফয়েজ</Font.>



নোয়াখালীর মত বাংলাদেশে আর এমন কোনো জেলা খুঁজে পাওয়া যাবেনা, যে জেলার আয়তন প্রাকৃতিক ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে নোয়াখালীর উপকূলে প্রতি বছর সাগর থেকে জেগে উঠছে বিপুল পরিমান ভূমি। এর ফলে বেড়ে যাচ্ছে নোয়াখালীর আয়তন। সুপরিকল্পিত ভাবে এ ভূমিকে ঘিরে কোনো সুদুর প্রসারী উদ্যোগ কেউ কখনো নেয়নি। প্রাকৃতিক আর রাজনৈতিক নানান টালমাটালে এ জেলা নানান ঘটনার স্বাক্ষী হয়ে আছে। বর্তমানে নোয়াখালীর উপজেলার সংখ্যা নয়টি। এ উপজেলা গুলোর কেন্দ্র বিন্দু নোয়াখালী শহর। তবে এ শহরের ভিন্ন এক যন্ত্রনাদায়ক ইতিহাস আছে। নতুন অনেকে নোয়াখালী শহরে এসে থমকে পড়েন। এখানে নোয়াখালী নামের কিছুই নেই। এ শহরটির নাম মাইজদী শহর। মাইজদী কোর্ট। সরকারি ভাবে বলা হয় নোয়াখালী সদর। কোনো হৈচৈ নেই। সন্ত্রাস বা বড় ধরনের কোনো ক্রাইমও নেই। গ্রাম আর শহরের মিশেল এক ছোট্ট ছিমছাম সোম্য শান্ত শহর। পুরো জেলায় কোনো রুক্ষতা নেই। সমস্ত জেলা জুড়ে শুধুই সবুজের স্নিগ্ধতা। নারিকেল সুপারি আর নানান বৃক্ষের ছায়া ঘেরা জেলা। পঞ্চাশের দশকে মূল নোয়াখালী মেঘনা আর সাগরে বিলিন হয়ে গেলে বৃটিশদের পরিকলপনায় নতুন করে এ শহরের পত্তন হয়। নোয়াখালী শহর যখন ভেঙ্গে যাচ্ছিলো তখন মাইজদী মৌজায় ধান ক্ষেত আর খোলা প্রান্তরে পুরাতন শহরের ভাঙ্গা অফিস আদালত গুলো এখানে এনে স্থাপন করা হয়। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে প্রায় ষোলো একর জুড়ে কাটা হয় এক বিশাল দীঘি। লোক মুখে প্রচলিত হয় বড় দীঘি নামে। সে দীঘির চতুর্দিকে চক্রাকারে বানানো হয় ইট সুরকীর রাস্তা। সে রাস্তাকে ঘিরে বাংলো প্যাটার্ণে তৈরী হয় সরকারী সব দপ্তর। রাস্তার পাশে রোপিত হয়েছিলো বকুল আর জারুল গাছ। কিছুদিন পরে গাছগুলো বড় হলে ফুলে ফুলে পুষ্পিত হয়ে অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়ে উঠে। এক অপরুপ রুপে শহর সাজতে থাকে। আশে পাশে নদী ভাঙ্গা বসতিদের বাড়ি ঘর উঠতে থাকে। এক রুচিশীল হারানো শহরের মানুষ গুলো রুচিশীলতা দিয়েই নতুন করে তৈরী করলো সেই সব। একটু একটু করে গড়তে থাকে শহর। গ্রামাঞ্চলের বড়িঘর গুলোও ছিলো সুঠাম ছিম ছাম। দেশের নানান যায়গা থেকে মানুষ জন দেখতে আসতো এ শহরটির রুপ। একটা অলিখিত পর্যটন শহর হিসাবে গড়ে উঠছিলো এটি। কিন্তু এ শহর বাসীর দুর্ভাগ্য সেই সৌন্দর্য সেই সৌষ্ঠব ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকলো। শহর স্থানান্তরের সময় নতুন শহরকে সাজিয়ে তুলতে মাইজদীতে অনেক যায়গা হুকুম দখল করা হয়েছিলো। যেগুলো সরকারের খাস জমি হিসাবে রক্ষিত আছে। মাইজদী শহরের বড় দীঘিকে ঘিরে যে সুন্দর আঙ্গিনা গড়ে উঠেছিলো পরবর্তীতে তাকে নষ্ট করে বস্তির মত গড়ে উঠে সরকারী ভবন। আনেক সরকারী জায়গা দখল করে গড়ে উঠলো দোকানপাট। অথচ সারা শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অনেক সরকারী জমি। বড়দীঘি ও তার চতুর্দিকের বকুল জারুলের বৃক্ষ শোভিত এ অঙ্গনকে নষ্ট না করে সে সব খাস জমিতে সরকারী ভবন গুলো নির্মান করা যেতো। এখন সে যায়গা গুলো কিছু বিরান হয়ে আছে আর কিছু অবৈধ দখলদারদের কব্জায় চলে গেছে। কিছু কিছু খাস জমি লুটেরা ভূমি দখলদারদের লোভাতুর দৃষ্টির মধ্যে আছে। পাঁয়তারা চলছে সেগুলোও দখলে নেবার। বড়দীঘি থেকে পানি উত্তোলন করে সারা শহরে পরিবেশন করা হতো। পানির কোনো দুষণ ছিলোনা। স্বচ্ছ পানিতে ভরে থাকতো বড় দীঘি। পরবর্তীতে সে দীঘির কোল ঘেঁসে কিছু ভবন তৈরী হয়। মল মূত্র আর ময়লা আবর্জনায় এখন প্রায় ভরে থাকে এ সুন্দর জলাশয়টি। অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু উদ্দ্যোগযে নেয়া হয়নি তা নয়। বিভিন্ন সময় পৌর কতৃপক্ষ এর সৌন্দর্য বর্ধনে কিছুটা উদ্যোগী হয়েছিলো। দীঘির এক পাড়ে মাটি ভরাট করে গাছ লাগিয়ে কিছুটা পার্কের আদল করার চেষ্টা হয়েছে। দীঘির চতুর্পাশে সে পার্ককে ঘিরে লোহার রেলিং দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু সে পর্যন্তই সার। স্থানে স্থানে কে বা কারা সে রেলিংগুলো খুলে নিয়ে গেছে। তবে এখন যে টুকু অবশিষ্ট আছে তা রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে শহরবাসি হয়তো কিছুটা স্বস্তি পেতো। কিছু অনন্য বৈশিষ্ট্যের জন্য অনেকের কাছে এ শহর বেশ সমাদৃত। সে বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম হলো এ শহর একেবারেই সন্ত্রাস মুক্ত একটি শহর। এ শহরে সন্ত্রাস নেই বল্লেই চলে। দ্বিতীয় এর বৈশিষ্ট হলো এর স্বচ্ছ পরিবেশ । যেহেতু এ জেলায় বড় কোনো মিল কারখানা নেই তাই এর বড় কোনো পরিবেশ দুষণও নেই। সবচেয়ে বড় দিক হলো কোলাহল মুক্ত একটি শহর হিসাবে এখনো এর সুনাম চতুর্দিকে। অনেকে এখানে এসে বাড়িঘর তৈরী করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে চান। এ জেলার বিপুল সংখ্যক মানুষ সারা পৃথিবীতে ছড়িযে ছিটিয়ে আছে। তাদের টাকা রেমিটেন্স বেশীর ভাগ জমি কেনার কাজে ব্যাবহার করা হয়। এসব কারনেই দিন দিন এখানের যায়গা জমির দাম বেড়ে যাচ্ছে।। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা সঠিক কাজে ব্যাবহার করে এ জেলাকে আরো সমৃদ্ধ করা যেতে পারে। একটি পর্যটন জেলা হিসাবে গড়ে উঠার সব রকম সুযোগ সুবিধাই এ জেলায় বিদ্যমান। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও প্রতিটি উপজেলার সাথে জেলা শহরের যোগাযোগ অনেক উন্নত। জেলা শহরের কাছাকাছিই রয়েছে কয়টি দর্শণীয় স্থান। এর মধ্যে আছে গান্ধীআশ্রম, বজরা শাহী মসজিদ, সোনাপুর গীর্জা, হরিণারাযন পুর জমিদার বাড়ি, রামভাইয়ের আশ্রম ইত্যাদি। আরো আছে নোয়াখালীর দক্ষিণে বিশাল খোলা প্রান্তর, বন বিভাগের সৃজিত বন। আছে হাতিয়া দ্বীপের দক্ষিনে সমুদ্র থেকে জেগে উঠা নিঝুম দ্বীপ। সবচেযে বড় বিষয় হলো এ জেলার প্রাকৃতিক পরিবেশ। একটি সবুজ ক্যানভাসের দৃশ্য অবলোকন করতে মানুষ হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়। প্রকৃতি প্রেমিকরা একটু দৃষ্টি মেলে ঘুরে দেখলেই এখানে এসে দেখতে পাবেন বাংলার এক অপরূপ রূপের জনপদ। বিপুল জনসমর্থন নিয়ে বর্তমান মহাজোট সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। এ অঞ্চলের উন্নয়নে নতুন সরকারের নানান প্রতিশ্র“তি রয়েছে। এ জেলার উন্নয়নে যে কোনো পরিকল্পনায় পর্যটনের বিষয়টি চিন্তায় থাকলে খুব অল্প খরচেই এ জেলাটি এক অনন্য জেলায় রুপান্তরিত হতে পারে।

মাহ্‌মুদুল হক ফয়েজ

প্রথম আলো- ৭ ফেব্রুয়ারী ২০০৯

Foez 02:09, 30 December 2009 (UTC)